২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সে সঙ্গে আগামী অর্থবছরেও মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রত্যাশা তার।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট পেশকালে তিনি এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে সংসদে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও সারের মূল্য কমে এসেছে। এ ছাড়া দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় ও খাদ্য সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে।’
এসব কারণে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত থাকবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আগামী অর্থবছরে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের কাছাকাছি দাঁড়াবে আশা করি।’
তবে অর্থমন্ত্রীর প্রত্যাশা কতটা বাস্তবায়ন হবে, তা অনেকটাই অনিশ্চিত। কেননা এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অবসান কবে হবে তা কেউ বলতে পারছে না। ফলে আগামী বছরও উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা থাকবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারিতে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মার্চে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে ওঠে। এপ্রিলে তা সামান্য কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমেছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বেড়েছে। মে মাসের তথ্য পাওয়া গেলে সেটা দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট) গিয়ে পৌঁছতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্ববাজারের অস্থিরতাকে সঙ্গী করে সরকার যখন আইএমএফের ঋণের শর্ত মেনে ভর্তুকি তুলে নিয়ে ধাপে ধাপে জ্বালানির দাম বাড়াচ্ছে, সেই সময়ে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছেন অর্থমন্ত্রী।
বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই সূচককে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে বেধে রাখার লক্ষ্য ঘোষণা করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। পরে তা সংশোধন করে ৬ শতাংশ করা হয়। তবে সেই লক্ষ্যও পূরণ করা যায়নি।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ১০ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশে, যা বহু বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের সংসারে তেল-নুনের হিসাব মেলাতে স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড চাপ পড়ছে।
এমন বাস্তবতায় গড় মূল্যস্ফীতি কী করে ৬ শতাংশে রাখা যাবে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় দেননি।
প্রবৃদ্ধি অর্জনে আরও কঠিন লক্ষ্য দিয়েছেন তিনি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কবে শেষ হবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব প্রতিনিয়ত পড়ছে অর্থনীতিতে। এমন অস্থির বৈশ্বিক পরিস্থিতির মধ্যে আগামী ডিসেম্বর অথবা পরবর্তী বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের এই মহাযজ্ঞ আয়োজনে রয়েছে বিশাল ব্যয়ের চাপ। পাশাপাশি এই ভোট ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
এসব সংকটের মধ্যেও আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ অর্জন করতে চান অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। আর সেই লক্ষ্য অনুযায়ী এবার জিডিপির মোট আকার নির্ধারণ করা হচ্ছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটেও মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ৭ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জিত হবে বলে লক্ষ্য ধরেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
কিন্তু ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) হিসাব কষে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, এবার ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি বলছে আরও কম; ৫ শতাংশের কিছু বেশি।
অর্থনীতি চাপে থাকার পরও কেন এবার বেশি প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা করছেন- সে ব্যাখ্যায় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ধীরে হলেও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে, বিশেষ করে আমাদের বাণিজ্য ও প্রবাস আয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং তা অব্যাহত থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এ বছরের এপ্রিলে প্রক্ষেপণ করেছে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্য, সার ও জ্বালানির মূল্য স্বাভাবিক হয়ে আসার সুবাদে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে বলেও আইএমএফ-এর প্রক্ষেপণে প্রকাশ পেয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতির অনুকূল পরিবর্তন আমাদের জন্য আশার সঞ্চার করছে। একইসঙ্গে কোভিড পরিস্থিতির সার্বিক উন্নয়নে দেশের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পূর্ণ গতি সঞ্চার হয়েছে। এছাড়াও, অর্থবছরের শেষাংশে কৃষি খাতে ভাল ফলন আসছে। সার্বিকভাবে, উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ ও উৎপাদশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং সুসংহত অভ্যন্তরীণ চাহিদার কল্যাণে অতীতের ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরে আমরা উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসব এবং ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারব বলে আশা করছি।’
করোনা ভাইরাস মহামারির আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ধারাবাহিক অগ্রগতির পথ ধরে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ (ভিত্তি বছর পরিবর্তনের পর যা ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ) প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বাংলাদেশ, যা ছিল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
গত এক দশকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। আর চার বছরে এই হার ছিল ৭ শতাংশের ওপরে। কিন্তু করোনার ধাক্কায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে নেমে আসে, যা ছিল তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম।