বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো তাদের খেলাপি ঋণের হিসাব ঠিকমতো দেখাচ্ছে না। খেলাপি ঋণ হিসাবের আন্তর্জাতিক আইন মানা হলে ব্যাংকগুলোর সম্পদ আরও কম হতো। কিন্তু ব্যাংকগুলো সেই আইন না মেনে নিজেদের সম্পদ বাস্তবের চেয়ে বেশি দেখাচ্ছে।
ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) চেয়ারম্যান মো. হামিদ উল্লাহ ভূঁঞা সোমবার এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন।
পুঁজিবাজারভিত্তিক সাংবাদিকদের সংগঠন ক্যাপিট্যাল মার্কেট জার্নালিস্ট ফোরাম (সিএমজেএফ) দেশের পুঁজিবাজার নিয়ে ‘সিএমজেএফ টক’ শীর্ষক এই আলোচনার আয়োজন করে।
হামিদ উল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশে আইএফআরএস মেনে হিসাব রাখার কথা। কিন্তু দেশের ব্যাংক খাতে আইএফআরএস ৯-এর নিয়ম মানা হচ্ছে না। বাংলাদেশে আইএফআরএস-এর সব আইন মানলে ব্যাংকের সম্পদ ৪০ শতাংশ অবলোপন করতে হবে বা কমে যাবে।
‘আইএফআরএস হচ্ছে হিসাব রক্ষণের আন্তর্জাতিক নিয়ম। এই নিয়মগুলো বিশ্বের সব দেশের কোম্পানি মেনে চলে, যাতে আর্থিক প্রতিবেদনগুলো স্বচ্ছ হয়।
‘আইএফআরএস-এর ৯ নম্বর আইনটিতে বলা আছে- কিভাবে একটি কোম্পানি তাদের আর্থিক দায় ও আর্থিক সম্পদের হিসাব রাখবে। ব্যাংক যে ঋণগুলো দেয় সেগুলো তাদের হিসাব বইয়ে আর্থিক সম্পদ হিসেবে থাকে। আন্তর্জাতিক মান ব্যবহার করলে এই ঋণ বা আর্থিক সম্পদ অনেক কম দেখাতে হতো।’
এফআরসি চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিবেদনে জালিয়াতি ঠেকাতে ২০১৫ সালে গড়ে তোলা হয় ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি)। এখন যদি কোনো হিসাব নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আর্থিক প্রতিবেদনে জালিয়াতি করতে সাহায্য করে তাকে শাস্তির আওতায় আনা যায়।
‘এ মুহূর্তে আইএফআরএস-এর ৯ ধারা বাস্তবায়ন করা হলে ব্যাংকের সম্পদ ৪০ শতাংশ রাইট অফ (অবলোপন) করতে হবে। আমরা চাই এটি বাস্তবায়ন করা হোক। তাহলে ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে।’
রাজধানীর পল্টনে সিএমজেএফ-এর নিজস্ব কার্যালয়ে এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ফোরামের সভাপতি জিয়াউর রহমান। সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবু আলী।
হামিদ উল্লাহ ভূঁঞা বলেন, ‘খেলাপি ঋণ বছরের পর বছর টেনে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। এই টাকা কি কখনো ফেরত পাওয়া যাবে? ব্যাংকগুলো যদি আদায় করতে সক্ষম হয় তাহলে সমস্যা নেই। তবে আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে দেখি খেলাপি ঋণ আদায় করা যায় না। বরং ২ শতাংশ জমা দিয়ে এগুলোকে আবার নিয়মিত ঋণে কনভার্ট করা হয়।
‘এ ২ শতাংশ দিয়ে তো ইন্টারেস্ট (সুদ আয়) আসে না। কারণ ইন্টারেস্ট তার চেয়ে অনেক বেশি। অথচ রি-সিডিউল করে রেগুলার করা হচ্ছে। আর ওই ঋণখেলাপি তখন আরেক ব্যাংকে গিয়ে লোন নিচ্ছে।’
হামিদ উল্লাহ বলেন, ‘আমি মনে করি আইএফআরএস-৯ বাস্তবায়ন করা হোক। ব্যাংকের সব ফিগার রিটার্ন অফ করে ব্যাংক একটি সেটেলড পজিশনে আসুক। কিন্তু সম্ভব না। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংক এটা মেনেই নিচ্ছে না।’
এফআরসিতে নিবন্ধিত হতে হবে অডিটরদের
আগামী ৩০ মে-র মধ্যে অডিটরদের এফআরসিতে নিবন্ধিত হতে হবে। কোনো অডিটর নিবন্ধিত না হলে তিনি তালিকাভুক্ত কোম্পানিসহ জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান অডিট করতে পারবে না।
এফআরসি চেয়ারম্যান বলেন, কোনো কোম্পানির রাজস্ব ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি হলে, সেই কোম্পানি জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোম্পানি হিসেবে বিবেচিত হবে।
এ ধরনের প্রতিষ্ঠান আছে ৩ হাজার চার শ’র মতো। এর বাইরে আড়াই হাজারের মতো ক্ষুদ্র ঋণ দেয়া প্রতিষ্ঠান আছে। এগুলোও জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হবে। সব মিলিয়ে সাড়ে ৫ হাজারের মতো প্রতিষ্ঠান জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট হিসেবে বিবেচিত হবে। কোনো অডিটর এফআরসিতে তালিকাভুক্ত না হলে এসব প্রতিষ্ঠান অডিট করতে পারবে না।
নিয়ম মানছে না বিমা কোম্পানি
হামিদ উল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, ‘জীবন বিমা কোম্পানিগুলো কখনও প্রফিট অ্যান্ড লস অ্যাকাউন্ট করে না। তারা একটা অ্যাকাউন্ট করে, সেটি হলো রেভিনিউ অ্যাকাউন্ট। কিন্তু আইএএস ১-এ স্পষ্ট বলা আছে, আপনার কোম্পানির নেচার যাই হোক না কেন প্রফিট অ্যান্ড লস অ্যাকাউন্ট করতে হবে। কিন্তু এরা তা করে না। এমনকি আমরা চিঠি দিলে রেসপন্সও করে না।
‘অন্যান্য রেগুলেটর কিছুটা হলেও রেসপন্স করে। এই একটা সেক্টর, যেখান থেকে আমরা আজ পর্যন্ত কোনো রেসপন্স পাইনি।’
এফআরসিকে শক্তিশালী করা হচ্ছে
হামিদ উল্লাহ ভূঁঞা বলেন, এফআরসিতে জনবল নিয়োগ দেয়ার পর আমি প্রথম হাত দেব ক্যাপিটাল মার্কেটে। আমি ক্যাপিটাল মার্কেটের কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতার অবস্থা দেখতে চাই। ক্যাপিটাল মার্কেটের কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনে যদি ম্যানিপুলেশন হয় তাহলে অনেক মার্জিনাল ইনভেস্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।