পরিচালনা পর্ষদের স্বার্থে ৩৩২ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছে শেয়ারবাজারে জীবন বিমা খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। চুক্তি ছাড়াই বিনিয়োগের নামে পরিচালকদের কোম্পানিতে দেয়া হয়েছিল এসব অর্থ। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে তা আদায় হচ্ছে না। আর তা নিয়ে দেখা দিয়েছে বড় শঙ্কা।
অন্যদিকে এসব ঋণের বিপরীতে কোনো সঞ্চিতি বা প্রভিশনিং করেনি কোম্পানিটি। এর মাধ্যমে মুনাফা ও সম্পদ বেশি করে দেখিয়েছে। আড়াল করছে কোম্পানির আর্থিক স্বাস্থ্যের প্রকৃত অবস্থা বা দুর্বলতা।
কোম্পানিটির বিগত অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনে নিরীক্ষকের তথ্যে এমন ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।
চুক্তি ছাড়াই কেন বিনিয়োগ করা হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো যৌক্তিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি কোম্পানির পক্ষ থেকে। অর্থ ফেরত পেতে পৃথক মামলা করেছে প্রাইম ইসলামী, যা চলমান। অর্থ ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী তারা।
প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি সচিব আবুল হাসনাত মোহাম্মাদ শামীম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই টাকা আদায়ের জন্য কোম্পানির পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে। হাইকোর্টে মামলা চলমান। মামলার কোনো সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত আমরা কিছু বলতে পারছি না।’
চুক্তি ছাড়াই কেন বিনিয়োগ করা হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে তো এখন কিছু বলা যাচ্ছে না। আমাদের আইনজ্ঞদের পরামর্শে মামলা চলছে। আমরা আশাবাদী টাকাগুলো ফেরত পাব। এখন অডিটররা যেমনটা মনে করেছেন সেভাবেই রিপোর্ট দিয়েছেন।’
নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিমা কোম্পানিটি থেকে সাবসিডিয়ারি প্রাইম ইসলামী লাইফ সিকিউরিটিজে ১৪৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, পিএফআই সিকিউরিটিজে ১৬৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা, বাংলালায়নে ৫ কোটি টাকা ও স্টারলিঙ্ক গ্রুপের ৪ কোম্পানিতে ১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। মোট এই ৩৩২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বিনিয়োগকে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি প্রাইম ইসলামী সিকিউরিটিজে ৬৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। সেখান থেকে ১৯ কোটি ৩০ লাখ টাকার লভ্যাংশ পাওনা হয়েছে, যা ২০১৮ সাল থেকে দেখিয়ে আসছে প্রাইম লাইফ।
তবে ওই লভ্যাংশের মধ্যে সবশেষ বছরে ১ কোটি টাকা সংগ্রহ হয়েছে। বাকি অংশ আদায় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন নিরীক্ষক। কারণ ব্রোকারেজ হাউজটি সবশেষ ২ বছর লোকসান গুনেছে।
এ ছাড়া হাউজটিতে আরও ৮৭ কোটি ৭২ লাখ টাকা স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ করা হয়। যদিও প্রকৃত বিনিয়োগ ৭৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এর বিপরীতে পাওয়া লভ্যাংশের ১১ কোটি ১৫ লাখ টাকা চুক্তি অনুযায়ী মূলধনে রূপান্তর করা হয়েছে। আর ৩ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। বাকি টাকা বিনিয়োগ দেখিয়ে আসছে। কিন্তু ওই বিনিয়োগের বিপরীতে রিটার্ন নিয়ে স্বচ্ছ কোনো চুক্তি নেই।
এদিকে বিমা কোম্পানিটি থেকে বাংলালায়নের জিরো কূপন বন্ডে ২০১৩ সালে (১০ শতাংশ রূপান্তরযোগ্য) ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। সে অর্থ আদায় নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। তারপরও কোম্পানিটি এর বিপরীতে কোনো প্রভিশনিং করেনি। বরং এর মাধ্যমে মুনাফা ও সম্পদ বেশি দেখিয়েছে।
বিমা কোম্পানিটি থেকে পিএফআই সিকিউরিটিজে ১৬৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ করা হয়, যে অর্থ ২০১৮ সাল থেকে আর্থিক হিসাবে দেখিয়ে আসছে। সে বিনিয়োগের বিপরীতে প্রাইম লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোনো লিখিত চুক্তি করেনি। ওই অর্থ আদায় না হওয়া সত্ত্বেও কোনো প্রভিশনিং না করে মুনাফা ও সম্পদ বেশি দেখিয়ে আসছে প্রাইম লাইফ। ওই অর্থ আদায়ে পিএফআই সিকিউরিটিজের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা করা হয়েছে।
স্টারলিং গ্রুপের ৪ কোম্পানিতে ২০১৮ সাল থেকে ১৫ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ দেখিয়েছে প্রাইম ইসলামী। সেটারও কোনো লিখিত চুক্তি নেই। নেই প্রভিশনিংও। বিপরীতে মুনাফা ও সম্পদ বেশি দেখিয়ে আসছে কোম্পানি। তবে অর্থ আদায়ে মামলা করা হয়েছে।
২০০৭ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া প্রাইম ইসলামী লাইফের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৩০ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এর মধ্যে পরিচালকদের হাতে ৩৬ দশমিক ০৮ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিকের হাতে ৩৯ দশমিক ৭০ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। সবশেষ বুধবার প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৬০ টাকা ৬০ পয়সায়।