উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও টাকার বিনিময় হারে নড়বড়ে অবস্থার চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করল বাংলাদেশ ব্যাংক।
রোববার এই মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। গত বছরের জুলাইয়ে গভর্নরের দায়িত্ব নেয়ার পর এটি তার প্রথম মুদ্রানীতি।
ঘোষিত মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি ও টাকার বিনিময় হারের উর্ধ্বমুখী চাপ নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদ হার আরেক দফা বাড়িয়েছে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান। তুলে নেয়া হয়েছে আমানতের সুদ হার। ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ধরনের ঋণের সুদ আগের মতোই ৯ শতাংশ অপরিবর্তিত রাখা হলেও বাড়ানো হয়েছে ভোক্তা ঋণের সুদ।
করোনা ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অভিঘাতে নাকাল বিশ্ব অর্থনীতি। এর প্রভাবে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রতিনিয়ত কমছে টাকার মান। এই সংকটপূর্ণ অবস্থার মধ্যে আগামী ছয় মাসের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করল বাংলাদেশ ব্যাংক।
মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি আগের মতোই ১৪ দশমিক ১ শতাংশ রাখা হয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে বাজারে মুদ্রার সরবরাহে লাগাম টানা হয়েছে।
তবে আমানতকারীদের জন্য সুখবর রয়েছে। গভর্নর জানান, ‘এখন থেকে ব্যাংকগুলো সামর্থ্য অনুযায়ী আমানতের সুদ দিতে পারবে।’
গভর্নর হিসেবে প্রথম মুদ্রানীতি ঘোষণার দিন তার কাছে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্ন ছিলো- ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব, মুদ্রা বাজারের অস্থিরতা ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপে আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রিত হয় কিনা। জবাবে গভর্নর বলেন, ‘কোনো চাপই আমাদের কাছে চাপ না।’
গত কয়েক বছর ধরে এক অর্থবছরে একটি মুদ্রানীতিই ঘোষণা করা হতো। এবারও তেমনটিই হবে বলে ধরে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু অর্থনীতিতে সৃষ্ট চাপ সামাল দিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের প্রথম কিস্তির টাকাটা যাতে ফেব্রুয়ারি মাসেই পাওয়া যায়, তা নিশ্চিত করতে বছরে দুটি মুদ্রানীতি ঘোষণার আগের অবস্থানে ফিরে আসে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বেসরকারি ঋণ আগের মতোই
নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের লক্ষ্য একই রেখেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। আগামী জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। জুলাই-ডিসেম্বরের মুদ্রানীতিতেও এটি তা-ই ছিল।
মুদ্রা সরবরাহে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ। এটা সরকারের কাঙ্ক্ষিত মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির সিলিংয়ের সমষ্টির তুলনায় কিছুটা কম। আগের মুদ্রানীতিতে অর্থ সরবরাহ নির্ধারণ করা হয়েছিল ১২ দশমিক ১ শতাংশ।
মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ।
সরকারের চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নিট ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ ঋণের লক্ষ্য দেয়া হয়েছে।
জাতীয় বাজেটে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকারের কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা হলো ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
ব্যাংক খাতে সুশাসন
মুদ্রানীতি ঘোষণার পর প্রশ্নোত্তর পর্বে গভর্নরের কাছে জানতে চাওয়া হয়- ইসলামী ব্যাংকগুলোকে নগদ অর্থ সহায়তা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাংকের মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকতে এ ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি এমন হলো কেন?
জবাবে তিনি বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকের ভিত্তি খুব শক্ত। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর ঋণে অন্য ব্যাংকের তুলনায় ঝুঁকি কম থাকে। ধার হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তাদের যে টাকা দেয়া হয়েছিল তারা পরদিন সে টাকা শোধ করে দিয়েছে। সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকই এটা করে থাকে।’
কোনো গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক খাত কিনা- এমন প্রশ্নে গভর্নর বলেন, ‘আমি কারও নাম উল্লেখ করতে চাই না। আমাদের ওপর কোনো চাপ নেই। আমি যে জায়গা থেকে এসেছি সেখানে বহু চাপের মধ্যে কাজ করেছি। সুতরাং কোনো চাপ আমাদের কাছে চাপ না।
‘একটা সময়ে কারা কারা আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণ করে এমন নাম বলা হতো। এখন করে কিনা এটা আপনারা (সাংবাদিক) ভালো জানেন। আমরা নিয়ম অনুযায়ী (রুল অফ ল’) যে যত টাকা ঋণ নিতে পারবে সেভাবেই কাজ করি। আমি তাকে গ্রাহক (ক্লায়েন্ট) হিসেবে দেখি। আর যে পরিচয় আছে সেটা আমার কাছে বিবেচ্য নয়। সব ব্যাংকে এভাবে নির্দেশনা দেয়া আছে। নিয়ম-কানুন, রুলস ব্রেক করলে আমরা তার সঙ্গে নেই।’
ইসলামী ব্যাংক ইস্যুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চুপ ছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না বাংলাদেশ ব্যাংক চুপ ছিল কিনা। আমাদের কিছু প্রসেস ফলো করতে হয়। আমরা কিন্তু অ্যাকশন নিয়েছি। আজকে কোনো পত্রিকায় একটা রিপোর্ট এলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কালকেই তাকে ধরে নিয়ে আসবে এভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করে না।’
সম্পদ পাচার, অর্থ পাচার করে অন্য দেশে বাড়ি বানাচ্ছে- এমন বিষয় নিয়ে প্রশ্নের জবাবে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘বেশ কিছু পণ্যের ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং হচ্ছে। এভাবে টাকা বের হয়ে যাচ্ছে। তবে এই টাকা বাড়ি কেনার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা সে তথ্য আমার কাছে নেই।’
তিনটি চ্যালেঞ্জ
অর্থনীতিতে এখন তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে জানান গভর্নর। বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের স্থায়িত্ব, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের পলিসি রিসার্চ ইন্টারেস্ট বাড়ানোর আগ্রাসী কার্যক্রম এবং চীনের কোভিড পরিস্থিতি।
এ তিনটি চ্যালেঞ্জ যত দ্রুত সমাধান হবে আমাদের অর্থনীতি তত দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে। তবে তিনটি ক্ষেত্রেই যদি পরিস্থিতি খারাপ হয় তারপরও আমাদের বর্তমান অর্থনীতি এর চেয়ে আর খারাপ হবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতির যে সহনশীলতা, যে কোনো একটা ধাক্কায় বাংলাদেশের অর্থনীতি কখনও পড়ে যাবে না। কোভিডের সময় আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। স্বল্প মেয়াদে দেশের যে অর্থনৈতিক অবস্থা এটা স্থিতিশীল থাকবে।’
মুদ্রানীতি ঘোষণা উপলক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, কাজী ছাইদুর রহমান, আবু ফরাহ মো. নাছের, এ কে এম সাজেদুর রহমান খান, বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বস, প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হকসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।