সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে আমদানি খাতে ব্যয় বেশ কমে এসেছিল; এক ধরনের স্বস্তি বোধ করছিল সরকার। কিন্তু অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ফের বাড়তে শুরু করেছে। দেখা দিয়েছে নতুন সংকট।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার আমদানি ব্যয়ের সবশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, বিদায়ী ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ৭০৩ কোটি ৪০ লাখ (৭.০৩ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত বছরের আগের বছরের (২০২১) নভেম্বরের চেয়ে ৩ দশমিক ২১ শতাংশ কম হলেও আগের মাস অক্টোবরের (২০২২) চেয়ে ১৪ দশমিক ২৪ শতাংশ বেশি।
করোনা মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় গত ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানি খাতে খরচ বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত বড় উল্লম্ফনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় অর্থবছর, রেকর্ড ৮২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি।
আমদানি বাড়ায় বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বেশ চাপের মুখে পড়ে। ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ২০২১ সালের আগস্টে যে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল, সেই রিজার্ভ এখন ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে।
বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৩ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভের এই চাপের মধ্যেই আগামী সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই সূচক আরও কমে ৩২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে।
অস্বাভাবিক আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের বেশ ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছিল। আমদানি ব্যয় বেশ কমে এসেছিল। ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছিল। এক ধরনের স্বস্তি বোধ করছিল সরকার।
আমদানি কমাতে প্রথম পদক্ষেপ নেয়া হয় গত বছরের ১৭ এপ্রিল। ওই দিন এক সার্কুলারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শিশুখাদ্য, জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী শিল্প এবং কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানি ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানির বিপরীতে ঋণপত্র স্থাপনের (এলসি) নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়। এরপর ১০ মে বিলাসপণ্য আমদানি কমাতে আরও কড়াকড়ি আরোপ করে আরেকটি সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সার্কুলারে বলা হয়, সব ধরনের মোটর কার, হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিকসসামগ্রীর আমদানি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে। একই সঙ্গে অতি জরুরি পণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে।
এরপর ৫ জুলাই আরও কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব ধরনের মোটর কার, হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিকসসামগ্রী, প্রসাধনী, স্বর্ণালংকার, তৈরি পোশাক, গৃহস্থালি বৈদ্যুতিকসামগ্রী বা হোম অ্যাপ্লায়েন্স, পানীয়সহ বেশ কিছু পণ্য আমদানিতে আমদানিকারকরা ব্যাংক থেকে কোনো ধরনের ঋণসুবিধা পাবেন না বলে ঘোষণা দেয়া হয়। এসব পণ্যের আমদানি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে শতভাগ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে বলা হয়, আগে যা ছিল ৭৫ শতাংশ।
অন্যদিকে রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ব্যয় সংকোচনের পথ বেছে নেয় সরকার। অতি প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের কর্তাদেরও বিদেশ সফর বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কম গুরুত্বপূর্ণ আমদানিনির্ভর প্রকল্পের বাস্তবায়ন আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে।
এসব প্রদক্ষেপের ফলে আমদানি ব্যয় বেশ কমে এসেছিল। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) প্রতি মাসে গড় আমদানি প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার ছিল। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে তা কমে ৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
এর থেকে তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে পণ্য আমদানিতে মোট ৬ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে এ খাতে খরচ হয় যথাক্রমে ৬ দশমিক ৬৫ ও ৬ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। সবশেষ নভেম্বর মাসে ৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে আমদানি ব্যয় ৭ দশমিক শূন্য ৩ বিলয়ন ডলারে উঠেছে।
সব মিলিয়ে অর্থবছরের পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) হিসাবে পণ্য আমদানিতে মোট ব্যয় হয়েছে ৩২ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। যা আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি।
সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমদানি বাড়ার ভালো দিকও আছে। অর্থনীতি বড় হলে আমদানি বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। আমদানি বাড়বে, দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। অর্থনীতি এগিয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমাদের আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। নানা পদক্ষেপে সেটা কমে এসেছিল। এখন আবার বাড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের রিজার্ভ কমছেই। এ অবস্থায় আমদানি রিজার্ভের উপর আরও বেশি চাপ পড়বে। তাই সরকার কৃচ্ছসাধনের যে পথে হাটছে, তা আরও কিছুদিন চালিয়ে যেতে হবে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও এডিবির ঋণগুলো পাওয়ার পর তখন ভিন্নভাবে চিন্তা করা যেতে পারে ‘
‘রপ্তানি বাড়ার কারণে আমদানি খরচ বাড়তে পারে’ এ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রে যুদ্ধের মধ্যেও কিন্তু আমাদের রপ্তানি বাড়ছে। নভেম্বর-ডিসেম্বর দুই মাসেই ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের সব কাঁচামালই (সুতা, কাপড়, রংসহ অন্য সব সরঞ্জাম) )কিন্তু আমদানি করতে হয়। যেহেতু রপ্তানি রপ্তানি, সেহেতু এ সবের আমদানি খাতে খরচ বাড়বে-এটাই স্বাভাবিক।’
আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বিদায়ী ২০২২ সালে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ডিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। রিজার্ভে বেশ বড় রকমের পতন হয়েছে। রপ্তানি বাড়লেও আমদানি আরও বেশি বেড়েছে। ফলে রিজার্ভ কমেছে।’
‘তবে, এখানে একটা প্রশ্ন আছে। আমদানির মাধ্যমে আসলেই জিনিসপত্র এসেছে, নাকি এর আড়ালে ওভার ইনভয়েসিং করে আমদানি বেশি দেখিয়ে সেই টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে, সেটা ভালোভাবে দেখতে হবে। বেশ কিছু দিন ধরে আমরা আমরা অর্থনীতিবিদরা এ বিষয়টি বলে আসছি। সম্প্রতি নতুন গভর্নর প্রমাণসহ কয়েকটি ঘটনার কথা জানিয়েছেন। এখন এ সবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।’
রমজান মাসে, চিনি, ভোজ্যতেল, খেঁজুরসহ আরও কিছু পণ্যের বাড়তি প্রয়োজন হয়। সেগুলোর আমদানিও শুরু হয়ে গেছে। এ কারণে আমদানি ব্যয় বাড়তে পারে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।