সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতির পারদ আরও খানিকটা কমেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ষষ্ঠ মাস এবং বিদায়ী ২০২২ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। আগের মাস নভেম্বরে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
এর অর্থ হলো গত বছরের ডিসেম্বর মাসে দেশের মানুষ যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এ বছরের ডিসেম্বরে মাসে তা কিনতে ১০৮ টাকা ৭১ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
নভেম্বর মাসে একই পরিমাণ পণ্য কিনতে তাদের লেগেছিল ১০৮ টাকা ৮৫ পয়সা। অক্টোবরে একই পরিমাণ পণ্য কিনতে লেগেছিল ১০৮ টাকা ৯১ পয়সা। সেপ্টেম্বরে লেগেছিল ১০৯ টাকা ১০ পয়সা। আর অগাস্টে লেগেছিল ১০৯ টাকা ৫২ পয়সা। ওই মাসের মূল্যস্ফীতি ছিল গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।
২০১০-১১ অর্থবছরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ। এরপর আর এই সূচক ৯ শতাংশের ওপরে ওঠেনি।
বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। দেশে জ্বালানি তেলের দাম ৫০ শতাংশের মতো বৃদ্ধি করার কারণে আগস্টে তা এক লাফে বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠে যায়। সেপ্টেম্বরে তা কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে নেমে আসে।
অক্টোবরে তা আরও কমে ৯ শতাংশের নিচে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশে নেমে আসে। নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয় ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। সবশেষ ডিসেম্বরে তা আরও কমে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশে নেমে এসেছে।
ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। নভেম্বরে এই হার ছিল ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। অক্টোবরে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ছিল ৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।
অন্যদিকে ডিসেম্বরে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আগের মাস নভেম্বরে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। অক্টোবরে ছিল ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে হয়েছিল ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ।
শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি এখনও বেশি
ডিসেম্বরে গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ১১ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ।
ডিসেম্বরে শহরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ার প্রবণতা ছিল। ঠিক এ রকম একসময়ে গত ৫ আগস্ট সরকার জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায়। এর পরপরই বাড়ানো হয় সব ধরনের পরিবহন ভাড়া। এই দুইয়ের প্রভাবে বেড়ে যায় প্রায় সব পণ্যের দাম। গত ২৯ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা কমানো হলেও বাজারে তার প্রভাব ছিল না বললেই চলে।
শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সব দেশের অর্থনীতির উদ্বেগজনক ও স্পর্শকাতর সূচক এখন মূল্যস্ফীতি। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠে ৯ শতাংশে পৌঁছেছে। ইউরোপের দেশগুলোও ধুঁকছে। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে যুক্তরাজ্যে বিক্ষোভও হচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি নিম্নমূখী হওয়ায় স্বস্তির কথা জানিয়েছে অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমন ধানের বাম্পার ফলনের কারণে বাজারে চালের দাম কেজিতে ৪/৫ টাকা কমেছে। তার একটা প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে পড়েছে। আগামী বোরো মৌসুমে ভালো ফলন হলে মূলষ্ফীতি সহনীয় থাকবে বলেই মনে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘তবে বিবিএসের মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন আছে। আমি এ বিষয়ে বারবার বলে আসছি, আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরোর মূল্যস্ফীতির তথ্যের সঙ্গে বাজারের বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন হয় না। বিবিএস ১৭ বছর আগের ভিত্তিবছরকে (২০০৫-০৬) ভিত্তি ধরে মূল্যস্ফীতির হিসাব করে। অথচ জিপিডির হিসাব দেখায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরকে ভিত্তিবছর ধরে। বাস্তব চিত্র পাওয়ার জন্য মূল্যস্ফীতির তথ্যও ২০১৫-১৬ অর্থবছরকে ভিত্তিবছর ধরে হিসাব করা উচিত বলে আমি মনে করি।’
শহরের চেয়ে গ্রামে খাবারের দাম বেশি কেন- এ প্রশ্নের উত্তরে আহসান মনসুর বলেন, ‘এর সঠিক কোনো উত্তর আমার জানা নেই। তবে এমন হতে পারে যে যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হওয়ার কারণে গ্রামের সব পণ্য এখন দ্রুত শহরে চলে আসছে। সে কারণে গ্রামে পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়ায় দাম বেড়ে যাচ্ছে।’
মজুরি সূচক বেড়েছে
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, গত কয়েক মাস ধরেই মজুরি সূচক অল্প অল্প করে বাড়ছে। অক্টোবরে এই হার ছিল ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। সবশেষ নভেম্বরে ছিল ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশে উঠেছে। আর ডিসেম্বরে তা আরও বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক শূণ্য তিন শতাংশে উঠেছে।