বিশ্ব অর্থনীতিতে যখন মন্দার শঙ্কা, আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যখন চাপে, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে যখন ভাটার টান, সে সময়ে চমকের পর চমক দেখিয়ে স্বস্তি দিচ্ছে রপ্তানি বাণিজ্য।
নভেম্বরে প্রথমবারের মতো এক মাসে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আয় করার পরের মাস ডিসেম্বর দিল আরও লাভ। এই মাসে রপ্তানি হয়েছে ৫ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বা ইপিবি সোমবার রপ্তানি আয়ের যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ২০২২ সালের শেষ মাসে রপ্তানি আয় এসেছে ৫৩৬ কোটি ৫২ লাখ ডলার।
এই অঙ্ক গত বছরের ডিসেম্বরের চেয়ে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি।
আগের মাস নভেম্বরে গড়ে রেকর্ড। দেশে প্রথমবারের মতো কোনো মাসে রেকর্ড গড়ে রপ্তানি হয় ৫ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। সেই রেকর্ড ভেঙে গেল এক মাস পরই।
রপ্তানি খাতের এই সাফল্য রীতিমতো বিস্ময়কর। কারণ সেপ্টেম্বর থেকে দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের যে ঘাটতি দেখা দেয়, তাতে উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল। কিন্তু ঘটেছে উল্টোটা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল। ওলটপালট হয়ে গেছে সব হিসাব-নিকাশ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশে দেশে মূল্যস্ফীতির পারদ চড়ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। নতুন বছরে মন্দা নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থা।
তছনছ হয়ে যাওয়া এই বিশ্ববাজারে রপ্তানি আয়ে রেকর্ডের পর রেকর্ডে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও রপ্তানিকারকরা। তারা বলছেন, রপ্তানি আয়ের এই উল্লম্ফনের ওপর ভর করেই ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশের অর্থনীতি।
নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভর করে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রপ্তানি আয় দাঁড়াল ২৭ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে তা ১০ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি।
এই আয়ের মধ্যে ২৩ বিলিয়ন ডলার বা ৯২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। ছয় মাসে এই খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
রপ্তানি বাণিজ্যে এই রেকর্ডের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে তৈরি পোশাক খাত। ডিসেম্বর মাসে ৪৬৬ কোটি ৫৪ লাখ (৪.৬৬ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করা হয়েছে, যা এই মাসের মোট রপ্তানি আয়ের ৯৭ শতাংশ। নভেম্বর মাসে এই খাত থেকে আয়ের অঙ্ক ছিল ৪৩৮ কোটি ডলার।
ডিসেম্বরে উল্লম্ফনের কারণে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) সামগ্রিক পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। নভেম্বর শেষে ছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অক্টোবর শেষে হয়েছিল ৭ শতাংশ।
পার পর দুই মাস ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি দেশে আসায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সত্যিই অবাক করার মতো তথ্য। এই কঠিন সময়ে আমাদের রপ্তানি খাতে এমন ভালো করবে ভাবতে পারিনি। এ সময় যেটার খুব দরকার ছিল, সেটাই হয়েছে। এই রপ্তানি আয়ের উপর ভর করেই আমরা ঘুরে দাঁড়াবো। নতুন বছর হবে আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর বছর।’
এবার রপ্তানি আয় ৬০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে আশার কথা শুনিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘চলতি অর্থবছরে আমরা ৫৮ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্য ধরেছিলাম। ছয় মাসে ২৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছি। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের ইতিবাচক ধারা আগামী দিনেও অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছি। সব মিলিয়ে এবার রপ্তানি আয় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৬০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফক অর্জন করবো।’
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কী, আমরা কল্পনাও করিনি এই কঠিন সময়ে এই এমন সাফল্য অর্জিত হবে। এটা আসলেই প্রত্যাশার চেয়ে বেশি পাওয়া।’
তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে। রিজার্ভ কমে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। এই পরিস্থিতিতে রপ্তানি আয় বাড়াটা খুবই দরকার ছিল। এখন রিজার্ভ আবার বাড়তে থাকবে। সরকারের পক্ষে চাপ মোকাবিলা করা সহজ হবে। আমরা সাহস পাবো।’
‘সবাই সম্মিলিতভাবে করোনার মতো যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট সংকটও আমরা সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করবো’ আশা কথা শুনিয়ে ফারুক হাসান বলেন, ‘প্রচলিত বাজারের পাশাপাশি অপ্রচলিত (নতুন) বাজারেও আমাদের রপ্তানি বেড়েছে। আগামী দিনগুলোতেও এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আমরা আশা করছি।’
অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা খুবই ভালো খবর যে, এই কঠিন সময়ে পর পর দুই মাস ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। আগামী দিনগুলোতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ এবং নতুন করে কোভিড দেখা দেওয়ায় চীনের অনেক রপ্তানি আদেশ বাংলাদেশে আসছে। ভিয়েতনাম থেকেও কিছু অর্ডর আসছে। আর বাংলাদেশ কম দামি অতি প্রয়োজনীয় পোশাক বেশি রপ্তানি করে। সে কারণে যুদ্ধের কারণে আমেরিকা-ইউরোপের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমলেও অতি প্রয়োজনীয় পোশাক তাদের কিনতেই হবে। সে কারণেই বলছি, মোটামুটি ভালেঅ একটা প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থবছর শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ডিসেম্বর মাসে রেমিট্যান্সও বেড়েছে। আইএমএফের প্রথম কিস্তির ঋণটাও ফেব্রুয়ারিতে পাওয়া যাবে। বিশ্বব্যাংক-এডিবির বাজেট সহায়তাও দ্রুত পাওয়া যাবে। সব মিলিয়ে রিজার্ভের উপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, সেটা আর থাকবে না। কোভিডের মতো এই সংকটও মোকাবিলা করতে পারবে বাংলাদেশ।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ২ হাজার ৭৩১ কোটি ১২ লাখ (২৭.৩১বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন দেশের বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা। এই সময়ে লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ২৭ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার।
২০২১-২২ অর্থবছরের এই ছয় মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ২৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। এ হিসাবেই প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে দশমিক ৪৪ শতাংশ।
৮৪.৫৭শতাংশই এসেছে পোশাক থেকে
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২২ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এই খাত থেকে আয় বেশি এসেছে ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই বছরে মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে ৮৪ দশমিক ৫৭ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। যার মধ্যে নিট পোশাক থেকে এসেছে ১২ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে বেশি এসেছে ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ১০ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। লক্ষ্যে চেয়ে বেশি আয় হয়েছে ৪ শতাংশ।
অন্যান্য খাত
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, অন্যান্য খাতের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য বড় খাতগুলোর মধ্যে শুধু চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই খাত থেকে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ৬৩ কোটি ৭৩ লাখ ডলার আয় হয়েছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ শতাংশ।
পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪৮ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে কমেছে প্রায় ১৮শতাংশ।
অন্যান্য খাতের মধ্যে এই ছয় মাসে হোম টেক্সটাইল রপ্তানি কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। কৃষিপণ্য রপ্তানি কমেছে ২৩ দশমিক ২৬ শতাংশ। হিমায়িত মাছ রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ২৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ওষুধ রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ২২ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
এছাড়া জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে ৩৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ, বাইসাইকেল রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ৬ শতাংশ। হ্যান্ডিক্যাফট থেকে কমেছে ৩০ শতাংশের বেশি।