উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে আরও একটি বছর শেষ হয়ে গেল। দুই বছরের করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২২ সাল। কিন্তু বছরের এক মাস যেতে না যেতেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার পর পাল্টে যায় বিশ্ব পেক্ষাপট। বিশ্ব অর্থনীতিতে নেমে আসে কালোমেঘ। ওলটপালট করে দেয় সব হিসাব-নিকাশ। তছনছ হয়ে যায় সব কিছু।
জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় দেশে দেশে চড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ আমেরিকান মুদ্রা ডলারের দর। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের তথ্যে ২০২২ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাত্র ২ শতাংশে নেমে আসবে।
এই অস্থিরতার ছোবল বাংলাদেশেও লেগেছিল; বেশ ভালোভাবেই লেগেছিল। এখনও প্রতি মুহূর্তে তার মাশুল গুনতে হচ্ছে। মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে নতুন উদ্যমে যে বছর শুরু করেছিল সরকার, সেটা তো সম্ভব হয়নি; উল্টো সেই জঞ্জাল আর সংকট সঙ্গে নিয়েই শুরু করতে হলো নতুন বছর ২০২৩ সাল।
বিদায়ী বছরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বড় ধাক্কা লেগেছে দেশের অর্থনীতিতে। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেখা দেয় ডলারের চরম সংকট। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে দেশের বাজারেও। সরকারের নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথার বড় কারণ হয়ে ওঠে মূল্যস্ফীতি। আগামী বছরেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এ বছরের নানা সংকটের মধ্যেও উচ্ছ্বাস ছড়ায় স্বপ্নের পদ্মা সেতু ও বহুল প্রতীক্ষিত মেট্রোরেল। বছরটিতে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে সুসংবাদ যেমন ছিল, তেমনি ছিল নেতিবাচক খবরও। বছরের শেষ দিকে এসে কয়েকটি ইসলামী ব্যাংকে আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ব্যাংকিং খাতে চরম দুরবস্থার চিত্র ফুটে ওঠে, যা সরকারকে বেশ বেকায়দায় ফেলে দেয়।
একটি ঝামেলাপূর্ণ বছরের শেষে বাংলাদেশকে ২০২৩ সালের নতুন সূর্যকে স্বাগত জানাতে হচ্ছে নানা চ্যালেঞ্জকে সামনে নিয়ে। এই চ্যালেঞ্জকে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন বলে অভিহিত করছেন দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ যদি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তাহলে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। ২০৪১ সালের স্বপ্ন, উন্নত সমৃদ্ধিশালী দেশের পথে অগ্রসর হবে বাংলাদেশ।’
আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার মতো ভাগ্য বরণ করতে হয়নি। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফুরিয়ে যাওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটি গভীর সংকটে পড়ে। পাকিস্তানের প্রায় একই অবস্থা এখন। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সবচেয়ে আলোচনা হচ্ছে অর্থনীতির যে সূচক নিয়ে, সেই বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ এখন ৩৪ বিলিয়ন ডলারের ওপরে অবস্থান করছে। পাকিস্তানের রিজার্ভ এখন ৫ বিলিয়ন ডলার; শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ এখন কত কেউ হিসাবে রাখে না।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের একজন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বীকার করছি যে, আমাদের অর্থনীতি চাপের মধ্যে আছে। তবে এটা জোর দিয়ে বলছি যে, অনেক দেশের চেয়ে ভালো আছি আমরা। নাই নাই করেও আমাদের রিজার্ভ এখনও ৩৪ বিলিয়ন ডলার। এই রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ছে; রেমিট্যান্স বাড়ছে; আমদানি কমেছে। রিজার্ভ আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে বলে আমি আশা করছি। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। আমনের ভালো ফলন হয়েছে। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ২০২৩ সালে আমরা ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়াব।’
মূল্যস্ফীতি
অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক মূল্যস্ফীতিই বিদায়ী বছরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে এসেছে। গত আগস্টে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠে গিয়েছিল। ওই মাসে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল দেশে; খাদ্য মূল্যস্ফীতি গিয়ে ঠেকেছিল প্রায় ১০ শতাংশে। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। সেপ্টেম্বরে অবশ্য এই সূচক ৯ দশমিক ১০ শতাংশে নেমে আসে। অক্টোবর ও নভেম্বরে ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৯১ এবং ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
সম্ভাবনার নতুন নাম পদ্মা সেতু
স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হয় গত ২৫ জুন। এরই মধ্যে এ সেতু দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পদ্মা সেতু ভবিষ্যতে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ থেকে দেড় শতাংশ বাড়াবে। যার প্রতিফলন ইতোমধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। পদ্মার এপার-ওপারে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার হতে শুরু করেছে।
মেট্রোরেলের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু
ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় নতুন একটি যুগ শুরু হয়েছে গত ২৮ ডিসেম্বর। বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয়েছে মেট্রোরেলের একাংশের। এর মধ্য দিয়ে বৈদ্যুতিক রেলের যুগে প্রবেশ করল দেশ। মেট্রোরেল ঢাকায় তীব্র যানজট সমস্যার উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি বাড়বে। অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করবে।
জ্বালানি তেলের রেকর্ড দাম বৃদ্ধি
বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে সরকার গত ৫ আগস্ট সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে। দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির এ হার দেশে রেকর্ড সৃষ্টি করে। মূল্যস্ফীতি যে এক লাফে সাড়ে ৯ শতাংশে উঠে গিয়েছিল, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি তাতে প্রভাব ফেলেছিল।
দ্রব্যমূল্যে ভোক্তার নাভিশ্বাস
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বব্যাপী ঊর্ধ্বমুখী চাহিদায় দেশেও পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে বিদায়ী বছরে। গড়ে পণ্যের আমদানি মূল্য বেড়েছে ৫০ শতাংশ। কোনোটির দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। অন্য সব ধরনের জিনিসের দামও ছিল ঊর্ধ্বমুখী। তাতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়ে যায়।
ডলার-সংকট ও রেকর্ড দাম
চলতি বছরে ব্যাংক খাতে আলোচিত ঘটনা ছিল ডলার-সংকট। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় এই সংকট আরও তীব্র হয়। তাতে খোলাবাজারে সেঞ্চুরি হাঁকায় ডলার; ছাড়িয়ে যায় ১২০ টাকা। এরপর ব্যাংকেও ডলারের দর সেঞ্চুরি করে। ব্যাংক খাতে কয়েক মাসের ব্যবধানে ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১০৫, ১০৬ বা ১০৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রিজার্ভে চাপ
ডলার-সংকট সামাল দিতে প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। তারপরও ডলারের বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। এর ফলে কমে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এখন সেই রিজার্ভ কমে ৩৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এক বছর আগে গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে রিজার্ভ ছিল ৪৬ বিলিয়ন ডলার।
ইসলামি ধারার ব্যাংকে ঋণ অনিয়ম
ইসলামি ধারার তিনটি ব্যাংক থেকে রাজশাহীভিত্তিক নাবিল গ্রুপকে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানকে যে ঋণ দেয়া হয় তা যাচাই-বাছাই না করে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সন্দেহ করা হচ্ছে নাবিল গ্রুপের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে এই ঋণ নেয়া হয়েছে অন্য কোনো পক্ষকে সুবিধা দেয়ার জন্য।
খেলাপি ঋণ বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ
খেলাপি ঋণ রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এ যাবতকালে এটিই সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের অঙ্ক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। করোনা মহামারিকালে ব্যাংকঋণ আদায়ে দেয়া বিশেষ ছাড় বছরের শুরুতে তুলে নেয়ার পর ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ।
গভীর ঘুমে পুঁজিবাজার
গত জুলাইয়ে পুঁজিবাজারে ক্রমাগত দরপতনের মধ্যে ডিএসইর সাধারণ সূচক ডিএসইএক্স ছয় হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে যায়। বাজারে লেনদেন খরা নিয়মিত চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ২৬ ডিসেম্বর ডিএসইতে হাতবদল হয়েছে ১৯৯ কোটি টাকা, যা গত ২ বছর ৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর চেয়ে কম লেনদেন হয়েছিল ২০২০ সালের ৭ জুলাই।
রপ্তানি আয়ে নতুন মাইলফলক
চলতি বছর দেশের পণ্য রপ্তানি অবশেষে ৫ হাজার কোটি ডলারের মাইলফলকে পৌঁছাল। সব মিলিয়ে গত জুনে সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ৪ লাখ ৮৬ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকার সমান। এই আয় ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি। একক মাসের হিসাবেও গত নভেম্বর মাসে নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ; এই মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। এর আগে কখনই এক মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে এত বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে আসেনি।
প্রবাসী আয়ে নিম্নগতি
অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেল চাঙা হওয়ায় চলতি বছর দেশে প্রবাসী আয় ১০০ কোটি ডলার কমবে বলে বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসেই প্রবাসী আয় ১৬০ কোটি ডলারের নিচে ছিল। চলতি মাসের প্রথম ২৩ দিনে (১-২৩ ডিসেম্বর) দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ১২৮ কোটি ৪২ লাখ ডলার। অর্থবছরের পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) রেমিট্যান্স প্রবাহে ২ দশমিক ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও, অর্থবছর শেষে এই প্রবৃদ্ধি থাকবে কী না-তা নিয়ে যথেষ্ট সংশ্রয় দেখা দিয়েছে।
মাথাপিছু আয় এখন ২,৮২৪ ডলার
দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। এক বছরের ব্যবধানে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ২৩৩ ডলার। গত পাঁচ বছরে এ দেশের মাথাপিছু আয় ৩৮ শতাংশের বেশি বেড়েছে। দেশের অভ্যন্তরে ও দেশের বাইরে থেকে একটি দেশে যত আয় হয়, সেটিকে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে মাথাপিছু আয়ের হিসাব করা হয়।
বিদেশ সফর ও আমদানিতে কড়াকড়ি
ডলার-সংকটের কারণে সরকারি কর্মচারী, ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় গত মে মাসে। এ ছাড়া চলতি বছর কম গুরুত্বপূর্ণ আমদানিনির্ভর প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পাশাপাশি নানা রকমের ফলমূল, প্রসাধনী আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বাড়তি শুল্কারোপ করা হয়।
অর্ধেকে নেমেছে এলসি খোলার পরিমাণ
দেশের রিজার্ভকে সংরক্ষণে পণ্য আমদানিতে নানা শর্তারোপের কারণে এপ্রিল থেকে টানা কমতে কমতে ছয় মাসে অর্ধেকে নেমে এসেছে এলসি খোলার পরিমাণ। চলতি বছরের মার্চে এলসি খোলা হয়েছে ৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারের। সেপ্টেম্বরে এলসি খোলা হয়েছে ৬ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলারের। অক্টোবরে এসে বড় ধরনের পতন হয়েছে। এ মাসে এলসি খোলা হয়েছে ৪ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারের।
রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কা
নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত রোম্যাপ অনুযায়ী ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনকে ঘিরে ২০২৩ সালে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার আশঙ্কা করছেন অনেকে। দীর্ঘদিন ধরে দেশে একটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছিল। যার সুফল পেয়েছে অর্থনীতি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) বাড়তে বাড়তে করোনার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। করোনার মধ্যেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে দেশে। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে দেশে।
ধারাবাহিক এই প্রবৃদ্ধি দেশে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের কারণেই সম্ভব হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে যদি আবার হরতাল-অবরোধ-জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়, তাহলে সেটা আর ধরে রাখা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
কেমন গেলো ২০২২ সাল-এ প্রশ্নের উত্তরে অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০২২ সাল অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীর কোন দেশের জন্যই ভাল ছিল না। পৃথিবীর পরিস্থিতি ছিল টালমাটাল। বাংলাদেশ এটা থেকে দূরে থাকতে পারেনি। বিশ্বায়নের যুগে এককভাবে থাকা সম্ভব না। আমরাও থাকতে পারি না। আমাদের দেশের সঙ্গে বিশ্বের মিল আছে। সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, এখনও বেশি আছে। ব্যালেন্স অফ পেমেন্টে একটি ঘাটতি আছে। এটাও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আছে। বিশ্বের সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াতে আমরা একটি বড় ধাক্কা খেয়েছি। তেল, চাল, ডালসহ যে কোন পণ্যের দাম বেড়েছে। নির্মাণ সামগ্রির দাম বেড়েছে। জাহাজের ভাড়া বেড়ে গেছে।’
‘তবে ভালো খবর হচ্ছে, এখন জ্বালানি তেলসহ বিশ্ববাজারে সব পণ্যের দামই কমেছে; বলা যায় বেশ কমেছে। সে দিক দিয়ে নতুন বছরে হয়তো কিছুটা স্বস্তি পেতে পারি আমরা। দেখা যাক কি হয়।’
তিনি বলেন, ‘২০২৩ সালে কিছু ভাল দিক আছে। আবার কিছু খারাপ দিক আছে। নতুন বছরেও আমাদের ডলার সংকট মোকাবিলা করতে হবে; এই সংকট তাড়াতাড়ি যাবে না। তবে আমি আশাবাদী বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য আরও কমে আসবে। তেলের দাম কমে আসবে। বাজারে চালের দাম কেজিতে ৪/৫ টাকা কমেছে। আমনের ফলন ভালো হয়েছে; আরও কিছুটা কমতে পারে। আর আগামী মৌসুমে বোরো ধানটা যদি ভালো হয়, তাহলে অনেকটা চিন্তামুক্ত থাকা যাবে। মূল্যস্ফীতিকে আমরা বাগে রাখতে পারব।’