করোনা মহামারির অভিঘাত মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালেও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে নতুন করে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, যুদ্ধের প্রভাবে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি।
এমন কঠিন পরিস্থিতিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট করতে যাচ্ছে সরকার। একইসঙ্গে এটা নির্বাচনি বাজেটও। কেননা এই অর্থবছরেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সব দিক বিবেচনায় নিয়ে বাজেট প্রণয়নে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা নিয়ে করণীয় ঠিক করতে মঙ্গলবার ‘আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের’ বৈঠক করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ওইদিন বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির বৈঠকও অনুষ্ঠিত হবে।
অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর আব্দুর রউফ তালুকদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনআরবি) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, অর্থ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরিফা খানসহ বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
সূত্র জানায়, বৈঠকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের খসড়া রূপরেখা তুলে ধরা হবে। নতুন বাজেটের সম্ভাব্য আকার, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হবে। একইসঙ্গে চলতি অর্থবছরে সরকারের আয়-ব্যয়ের হালনাগাদ তথ্য নিয়েও আলোচনা হবে।
বৈঠকে চলতি বছরের বাজেট পর্যালোচনা ও আগামী বাজেটের সম্ভাব্য রূপরেখা সম্পর্কে ধারণা দেয়া হবে অর্থমন্ত্রীকে। এরপর এপ্রিলে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে সংশোধিত ও নতুন বাজেটের সম্ভাব্য আকার চূড়ান্ত করা হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে জুনের প্রথম সপ্তাহে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী।
আগামী বাজেটটি এই সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জাতীয় নির্বাচনের আগে এটি হবে বর্তমান সরকারের শেষ বাজেট। আগামী জুনে যে বাজেট ঘোষণা করা হবে তা অর্থবছরের ছয় মাস বাস্তবায়ন করতে পারবে বর্তমান সরকার। বাকি অর্ধেক করবে নতুন সরকার। ফলে নানা প্রতিকূলতা থাকার পরও নির্বাচন সামনে রেখে নতুন বাজেট সাজাতে হবে সরকারকে।
অস্বীকার করার উপায় নেই, এ মুহূর্তে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। অবশ্য সারা বিশ্বের জন্যই এটি এখন প্রধান সমস্যা।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করাই হবে আগামী অর্থবছরের বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি নানা অভিঘাতের মধ্য দিয়ে চললেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য একটি সম্প্রসারণমূলক বাজেট দেবে সরকার। সরকারের শেষ মেয়াদে উন্নয়ন কাজে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সে জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকারও বড় হবে।
বর্তমানে এডিপির আকার ২ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। নতুন এডিপির আকার বর্তমানের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি হতে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, ১০ শতাংশ বেশি বরাদ্দ ধরে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের সম্ভাব্য আকার চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। চলতি অর্থবছরে বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে আগামী বাজেটের আকার ৭ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে এবার জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন হচ্ছে না তা মোটামুটি নিশ্চিত। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে নতুন অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন হতে পারে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ, যা এবার আছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
দেশের অভ্যন্তরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে গড় মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের বেশি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ কবে থামবে আর পরিস্থিতি কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। ফলে আগামীতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা থাকবে। এ বিবেচনায় নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৭ শতাংশ ধরতে যাচ্ছে সরকার।
মূল্যস্ফীতি ছাড়াও সরকারের বড় চিন্তার বিষয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ডলার সংকট মোকাবিলায় প্রধান দুই সূচক রপ্তানি ও রেমিট্যান্সেও বড় ধরনের সুখবর নেই। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাধ্য হয়েই ঋণ সহায়তা চেয়ে উন্নয়ন সহযোগীদের চিঠি দিয়েছেন। ইতোমধ্যে আইএমএফের ঋণ পাওয়ার নিশ্চয়তা মিলেছে।
এসব উদ্যোগের ফলে আগামীতে বিদেশি সহায়তা বেশি পাওয়ার প্রত্যাশা করছে সরকার। সে হিসাবে নতুন বাজেটে বিদেশি উৎস থেকে বিশাল অঙ্কের সহায়তা আসছে। এতে করে বড় বাজেট করা সরকারের জন্য কিছুটা হলেও সহজ হবে বলে মনে করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।