“ব্যাংক খাত তদারকিতে ‘সফট-টাচ’ আর ‘নো-টাচ’ নীতি বিদ্যমান। কিছুই করব না, কিংবা কিছু করলেও মৃদুভাবে করব- এমন অবস্থা চলছে। ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়ে দেয়া হয়েছে, কিন্তু তাতে কি কাজ হবে? অ্যাকশন নিতে হবে।”
‘সংকটে অর্থনীতি: কর্মপরিকল্পনা কী হতে পারে?’ বিষয়ে সংলাপে ব্যাংক খাত নিয়ে এমন কথা বলেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর।
শনিবার রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে এই সংলাপের আয়োজন করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডি।
তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা আলোচনায় ব্যাংক খাতের দুর্বলতা, তদারকি, ঋণ, অনিয়মসহ নানা বিষয় উঠে আসে। আলোচকরা প্রায় সবাই ব্যাংক খাতের দুর্দশার প্রসঙ্গ সামনে আনেন।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়া হচ্ছে। শুধু ব্র্যাক ব্যাংকের গেল মাসে অতিরিক্ত আমানত বেড়েছে ৩৬ ভাগ। কিন্তু সার্বিক আমানত কমে যাওয়া সংকটের বার্তা দেয়।
‘ব্যাংকে ৬-৯ সুদহার ধরে রাখা ভুল পদক্ষেপ। এতে উসকে যাচ্ছে মূল্যস্ফীতি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে মূল্যস্ফীতি কমছে। তারপরও সেখানে সুদহার বাজারভিত্তিক করা হচ্ছে।’
সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী।
আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এবং বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের এমডি রূপালী হক চৌধুরী।
মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
ব্যাংক খাত সংস্কারে পদক্ষেপ নেই
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ব্যাংক খাত এখনও দুর্বল। অথচ সংস্কারে পদক্ষেপ নেই। খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঋণ দেয়ায় অনিয়ম এখনও আছে। সুশাসন ও সংস্কারের অভাবে এই খাত ক্রমাগতভাবে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ছে। ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের ক্ষেত্রে বড় দুর্বলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের উন্নতি না হলে, এ ধরনের ঘাটতি রয়েই যাবে। খেলাপি যা বলা হচ্ছে বাস্তবে তা অনেক বেশি। আইএমএফসহ সংশ্লিষ্টরা এটা বারবার বলছে। তাদের ধারণা, সব সূচক যদি বিবেচনায় নেয়া হয়, তাহলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। বর্তমানে যোগ হয়েছে ব্যাংকের তারল্য সংকট।
উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণ স্থিতি ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৯৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।
ব্যাংকের ঋণ-আমানতে ৯ ও ৬ শতাংশ সুদহার ধরে রাখা ভুল সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে বলা হয়, ‘ধারাবাহিকভাবে ব্যাংকের আমানত কমে যাচ্ছে। কিন্তু সংস্কারে কোনো পদক্ষেপ নেই।’
পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে সময়ের সঙ্গে সুদহার সমন্বয় করেছে। কিন্তু এখানে সেটা করা হয়নি। আমরা ৬-৯ ধরেই বসে আছি। বিশ্বের অনেক দেশে পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু আমরা একই জায়গা ধরে আছি। ডলার সংকট সরকারের পক্ষ থেকে জানুয়ারি মাসে শেষ হবে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু এটা আরও ছয় মাস থাকবে বলে আমি মনে করি।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে অনেকে ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়েছে। এ জন্য আমানত তুলে নেয়ার ফলে আমানতে প্রবৃদ্ধি ৬ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে আছে। এটা স্থিতিশীল নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার অ্যাপ্রোচ হলো সফট টাচ বা নো টাচ। ব্যাংকে লুটপাট হলেই পর্যবেক্ষক দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু পর্যবেক্ষক বসিয়েও কোনো লাভ হয় না। তার সামনেই সব হয়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংকগুলোতে ঋণ দেয়ায় অনিয়ম, সুশাসন ও সংস্কারের অভাব রয়েছে। ফলে এই খাত ক্রমাগতভাবে দুর্বল হচ্ছে। খেলাপি ঋণের পাশাপাশি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের উন্নতি না হলে, এ ধরনের ঘাটতি রয়েই যাবে।’
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘অর্থনীতিতে কী ঘটেছে, বিভিন্ন ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অভ্যন্তরীণ চাহিদা যেহেতু বাড়ছিল, সেহেতু এর ব্যবস্থাপনাটা দেখার দায়িত্বের কথাও এসে যায়। মূল্যস্ফীতি যখন বাড়তে থাকল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন কী করল? যে মুদ্রানীতির কথা আমরা শুনেছিলাম, তাতে সংকোচনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তথ্য-উপাত্তে তা আর দেখা যায়নি।’
রিজার্ভের বিষয়ে সিপিডি বলছে, রিজার্ভের হিসাব নিয়ে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। রিজার্ভের কারণে এলসি খোলা কিংবা আমদানির ক্ষেত্রে চাপ তৈরি হয়েছে। রপ্তানি বাড়লেও কারেন্ট হিসাব ব্যালান্স নেতিবাচক। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে এসেছে। বিদেশে মানুষ যাওয়ার প্রবণতা বাড়লেও রেমিট্যান্স বাড়ছে না। এখানে হুন্ডি মার্কেটের বিরাটভাবে প্রভাবিত করছে, সরকারের আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা থাকা সত্ত্বেও রেমিট্যান্স বাড়ছে না।
শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘বিগত ১ দশকে আমরা একটি নীতিবিহীন অর্থনীতির মধ্যে চলছি। আগে কিছু ভারসাম্য ছিল। আগে সংসদে অনেক কিছু প্রতিফলিত হতো। গত চার বছরে আমরা তিন-চারজন সংসদ সদস্য, সিভিল সোসাইটির কাছ থেকে যা শুনি, যেটাকে আমাদের যৌক্তিক মনে হয়েছে, আমরা কোনো না কোনোভাবে সংসদে উপস্থাপন করেছি। কিন্তু বলার পরে কোনো কাজ হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘গত ১০ বছর আমি এক কথা বলে আসছি। কারণ কোনো পরিবর্তন হয়নি। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, ড্রামাটিক ফ্লাকচুয়েশন, দুর্বল ব্যাংকিং খাতসহ আরও অনেক কিছু এগুলোর কোনো কিছুই করোনা বা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত না। এগুলোর মূল কারণ খেলাপি ঋণ, ব্যাংক লুট। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো থেকে যেই পরিমাণ টাকা লুট হয়ে গেছে সেই পরিমাণ টাকা মনে হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও লুট করেনি। শেয়ার মার্কেটে ধস কয়েকবার হয়েছে। কিন্তু একটারও সে রকম কোনো তদন্ত হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হিউজ কোনো টাকা আর্ন করে, তার লক্ষ্যই থাকবে এই টাকা বিদেশে পাচার করে দেবে। এটি একটি চক্র হয়ে গেছে। অবৈধ পথে আয় করা, অবৈধভাবে ডিফল্ট ঋণ নেয়া, ঋণগুলোকে অবলোপন করা এবং টাকা পাচার করা। এই চক্রের মধ্যে আমলা, রাজনীতিবিদ এবং একটি দুষ্কৃতকারী ব্যবসায়ী চক্র জড়িত।’