জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৯৮৫-৮৬ অর্থবছরে বাংলাদেশে করপোরেট করহার ছিল ৫০ শতাংশ। সেটি ধাপে ধাপে কমতে কমতে এখন এসে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ২৭ শতাংশে। অর্থাৎ প্রায় চার দশকে করপোরেট কর হার কমেছে ৪৫ শতাংশ।
কিন্তু সরকার যে উদ্দেশ্যে করপোরেট কর হার ধাপে ধাপে কমিয়ে আনছে, সেই লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বছর শেষে মুনাফার ওপর যে কর দেয়, সেটাই করপোরেট কর। শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত এবং তালিকাভুক্ত নয়– এই দুটি শ্রেণিতে করপারেট কর আদায় করা হয়ে থাকে।
রাজস্ব বোর্ডের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার সাড়ে ২৭ শতাংশ এবং তালিকাবহির্ভূত সাড়ে ২২ শতাংশ।
দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তারা বলেছেন, করহার কমলেই বিনিয়োগ বাড়বে, এটা জোর দিয়ে বলা যায় না। এর সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অবকাঠামো উন্নয়ন, আমদানি-রপ্তানি নীতি, বাণিজ্য নীতি, শ্রমবাজারসহ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিষয়টি জড়িত।
তাদের মতে, করহার কম হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেন। কারণ এতে করে তাদের মুনাফা বাড়ে এবং তারা মুনাফার একটি অংশ দেশে ফেরত নিতে পারেন বা পুনরায় বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হন।
পরিসংখ্যান বলে, করপোরেট কর ক্রমাগত কমানো হলেও গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে বেসরকারি বিনিয়োগ একটি জায়গায় স্থবির হয়ে আছে। এটা জিডিপির ২৩ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিনিয়োগ যা বাড়ছে, সেটা সরকারি খাতে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, উচ্চ ও টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির কমপক্ষে ৩০ শতাংশ হওয়া উচিত। কিন্তু কর হার কমানো, কর প্রণোদনা দেয়া, ঋণের সুদহার কমানো, আইনকানুন পরিবর্তনসহ নানা পদক্ষেপের পরও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না।
এমন বাস্তবতায় সরকারি বিনিয়োগ অর্থাৎ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে বর্তমান সরকার।
এনবিআরের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৮৫- ৮৬ অর্থবছরের বাজেটে করপোরেট কর হার ৫০ শতাংশ ছিল। এর পর ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯০-৯১ অর্থবছরের বাজেটে কমিয়ে ৪৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে সাড়ে ৪২ শতাংশ, ২০০০-০১ অর্থবছরে ৪০ শতাংশ, ২০০৮-৯ অর্থবছরে ৩৭ শতাংশ, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩৫ শতাংশ।
করোনার পর দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিনিয়োগকে চাঙ্গা করতে করপারেট কর হার কমানো হয় পর পর তিন অর্থবছর। এর মধ্যে ২০২০-২১ বাজেটে সাড়ে ৩২ শতাংশ, ২০২১-২২ বাজেটে ৩০ শতাংশ এবং চলতি অর্থবছরে সাড়ে ২৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। তবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার আরও কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় সাড়ে ২২ শতাংশ।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোপেরেট কর কমালে বিনিয়োগ উৎসাহিত হয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বিনিয়োগ বৃদ্ধির এটিই একমাত্র পথ। এর সঙ্গে অর্থনীতির অন্যান্য সূচক ভালো হতে হবে। তবে বিদেশিরা করপোরেট কর দেখার পর বিনিয়োগে এগিয়ে আসে।’
সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক ঊর্ধ্বতন পরিচালক ও বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘ট্যাক্স রেট কত, তা দেখে বিদেশিরা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। সে জন্য করপোরেট করহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এবং তালিকা-বহির্ভূত কোম্পানির মধ্যে কর হারের পার্থক্য কমপক্ষে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলে বিনিয়োগের সুফল পাওয়া যায়, যা এখন আছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।’
১৯৮৪ সালের আয়কর আইনে করদাতা দুই ধরনের। ব্যক্তি শ্রেণি করদাতা এবং কোম্পানি করদাতা। সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশে ব্যক্তি শ্রেণির চেয়ে কোম্পানি করদাতা কম হলেও এ খাত থেকেই কর বেশি আদায় হয়।
মোট করদাতার মাত্র ২ শতাংশ কোম্পানি করদাতা। এদের থেকে মোট আয়কর আদায় হয় ৬৫ শতাংশ। বাকি ৩৫ শতাংশ ব্যক্তি শ্রেণি, উৎসে করসহ অন্যান্য খাত থেকে আদায় করা হয়।
রেজিস্টার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানির হিসাবে, দেশে দেড় লাখের বেশি কোম্পানি থাকলেও নিয়মিত কর দিচ্ছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ৩৫ হাজার।
এখন পর্যন্ত একক খাত হিসেবে ব্যাংক থেকে সবচেয়ে বেশি করপোরেট কর আদায় হয়।
বিনিয়োগে বাধা অনিশ্চয়তা
বর্তমানে প্রণোদনার বাইরে ব্যাংকগুলোর তেমন ঋণ বিতরণ নেই। কারণ ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছেন না। তারা বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশের অপেক্ষায় আছেন।
বিনিয়োগে সমস্যা এখন কোথায়, এমন প্রশ্নের জবাবে শিল্পোদ্যোক্তা ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, ‘অনিশ্চয়তাই বড় বাধা। করোনার কারণে সারা বিশ্বে এখন টালমাটাল চলছে। এ অবস্থায় উদ্যোক্তারা আস্থাহীনতায় ভুগছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থায় কোনো সমস্যা নেই। প্রয়োজন অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙা করা।’