শ্রীমঙ্গল উপজেলার উত্তরসুর এলাকায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পভিত্তিক (বিসিক) শিল্পনগরী গড়ে তোলা হয় ২০১২ সালের জুলাই মাসে। বিশাল প্লট, সুবিশাল সীমানা দেয়াল, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়। কর্মকর্তাদের জন্য বানানো হয় একাধিক অফিস ভবন। ডাম্পিং ইয়ার্ড, মসজিদ, পুকুর এবং অন্যান্য সুবিধারও বন্দোবস্ত করা হয়।
এত সব সুযোগ-সুবিধা সত্ত্বেও সারা বছর তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে এই বিসিক শিল্পনগরীটি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখানে প্লটের দাম অনেক বেশি ধরা হয়েছে। তা ছাড়া নিরাপত্তার অভাব আছে। এ কারণে কাঁচামালের প্রাপ্যতা থাকা সত্ত্বেও উদ্যোক্তারা এখানে প্লট নিতে আগ্রহী হচ্ছেন না।
শ্রীমঙ্গলের ব্যবসায়ী আবুল কালাম বলেন, ‘বিসিকে জমির (প্লটের) দাম তিন গুণ। সরকার কোনো ভর্তুকি না দিলে এসব প্লটে শিল্প স্থাপন সম্ভব নয়। সারা দেশে যেখানে মানুষ প্লট নিতে প্রতিযোগিতায় নামে, সেখানে শ্রীমঙ্গলের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। প্লট আছে, কিন্তু ক্রেতা নেই।’
ব্যবসায়ী মেঘনাদ হাজরা বলেন, ‘বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামালের জন্য বিখ্যাত শ্রীমঙ্গল, সেই সঙ্গে সিলেট বিভাগের এটি আদি ব্যবসাকেন্দ্র। এখানে বিনিয়োগ করলে অবস্থানগত কারণেই ব্যবসা লাভবান হয়। তবুও কেন প্লট নিয়ে মানুষ বিনিয়োগ করছে না, তা কর্তৃপক্ষের ভেবে দেখা উচিত এবং সেভাবেই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।’
সরেজমিনে বিসিক এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দুটি ভবনে একজন প্রহরী ছাড়া কোনো জনবল নেই। তালাবদ্ধ সুউচ্চ সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে জঙ্গল গজিয়ে উঠেছে।
প্রহরী বিশ্বজিৎ সরকার বলেন, ‘কয়দিন আগেও এখানে চুরি হয়েছে। থাকার কথা সাতজন গার্ড। কিন্তু আমি একা আছি।’
গেটের পাশেই কথা হয় স্থানীয় যুবক কবির মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘যখন এখানে স্থাপনা তৈরি হয়, এলাকার মানুষ খুশি হয়ে ভেবেছিল, এখানে কলকারখানা হবে, এলাকার বেকারত্ব দূর হবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে শুধু এলাকার একটু সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়েছে, আর কিছু না। সারা দিন তালাবদ্ধ অবস্থায় থাকে। আর কিছুই এখানে চোখে পড়ে না।’
বিসিক কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১২২টি প্লটের শিল্পনগরী গড়ে তুলতে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে এই নগরী গড়তে। ২০১২ সালের জুলাই মাসে ২০ একর জমির ওপর এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর বাস্তবায়নের তারিখ জুলাই, ২০১২ থেকে জুন, ২০১৯।
২০১৯ সালে প্রাথমিকভাবে মাত্র তিনটি প্লট তিন উদ্যোক্তা নেন। তবে তারা পরে অর্থ জমা না দিয়ে বরাদ্দ বাতিলের আবেদন করেন এবং প্রথম কিস্তির অর্থ ফিরিয়ে নেন।
এরকমই এক উদ্যোক্তা পুলক সূত্রধর বলেন, ‘আমি প্লট নিয়েছিলাম। পরে অন্যদের কাউকে এখানে প্লট নিতে আগ্রহী হতে না দেখায় আমিও টাকা ফেরত নিয়েছি। বিসিকের বাইরে কম টাকায় জমি কিনে আমি আমার কারখানা স্থাপন করেছি।’
বিসিক কর্তৃপক্ষ জানায়, প্লট বরাদ্দে উদ্যোক্তাদের আগ্রহী করতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের নিয়ে সেমিনার ও কর্মশালা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি এক উদ্যোক্তা একই প্রতিষ্ঠানের নামে ৪০টি প্লট বরাদ্দের জন্য আবেদন করেছেন। বিসিক জেলা প্লট বরাদ্দ কমিটি সেগুলো প্রধান কার্যালয় থেকে ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছে।
জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, ‘এখানে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও কেন বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হচ্ছেন না, তা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে দেখা হবে। এখানে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার পরিকল্পনা নেয়া হবে।’
তবে স্থানীয় উদ্যোক্তারা বলছেন, শ্রীমঙ্গলে বিপুলসংখ্যক ছোট-বড় কারখানা গড়ে উঠেছে গত কয়েক বছরে। অনেকেই নতুন উদ্যোগ নিতে চান। কিন্তু জমির দাম বেশি হওয়ার কারণে বিসিকে প্লট নিতে মানুষ আগ্রহী না।
স্থানীয় বিনিয়োগকারী রাজু ঘোষ বলেন, ‘জমির দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ায় ক্রেতারা প্লট কিনতে আগ্রহী নন। তার ওপর কোনো প্রচার নেই, ভবন বানাতে বিসিককে যতটা আগ্রহী দেখা গেছে, অন্য বিষয়ে ততটা নয়। একজন উদ্যোক্তা কখনও জেনে-শুনে তার বিনিয়োগের টাকা শুধু জমির পেছনে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করবেন না।’
টি প্ল্যান্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সদস্যসচিব জহর তরফদার বলেন, ‘রাস্তার পাশের জমির বর্তমান মূল্য দেড় লাখ টাকা এবং সামান্য ভেতরে ১ লাখ টাকা। অথচ বিসিকের জমির মূল্য ধরা হয়েছে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। এত দাম দিয়ে কে কিনবে বুঝতে পারছি না।’
শ্রীমঙ্গল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, ‘বিসিক নিয়ে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ নেই। নতুন উদ্যোক্তাদের বিসিক টানতে পারছে না। যারা আগে কারখানা করেছেন তাদের বেশির ভাগ নিজের জায়গায়ই করছেন। এখন যারা করবেন বা করছেন, তাদের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। জায়গার দাম স্থানীয় বাজারের সঙ্গে মিল থাকতে হবে। ২-৩ গুণ বেশি দিয়ে মানুষ কেন জায়গা কিনতে যাবে?’
মৌলভীবাজার বিসিকের উপব্যবস্থাপক মো. বেল্লাল হোসেন ভূঁইয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথম ধাপে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে আবেদন চাওয়া হলেও মাত্র তিন উদ্যোক্তা সাড়া দেন। পরে তারা তাদের প্লট বাতিল করেন। উপর মহল থেকে যেভাবে নির্দেশনা আসছে, সেভাবেই প্রচার চালানো হচ্ছে। প্লট তৈরিতে খরচ বেশি হওয়ায় প্লটের দাম বেশি।’
তিনি জানান, বিসিকের প্লটের দাম ১০ কিস্তিতে পরিশোধ করা যায়। এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি সুযোগ। সম্প্রতি একটি প্রতিষ্ঠান ৪০টি প্লট চেয়ে আবেদন করেছে।