সরকারের জন্য আরেকটি সুখবর। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পর আরেক ঋণদাতা সংস্থা এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) বাংলাদেশকে ২৫ কোটি ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ১০০ টাকা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকা।
বুধবার এই ঋণ নিয়ে সরকারের সঙ্গে চীনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এআইআইবির একটি চুক্তি হয়েছে। বাজেট সহায়তা হিসেবে এই ঋণ দেবে সংস্থাটি। ভার্চুয়াল মাধ্যমে চুক্তি সইয়ের কথা জানিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলার সংকটের মধ্যে আইএমএফের পর এআইআইবির এই ঋণ সরকারকে স্বস্তি দেবে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।
সামাজিক উন্নয়নকে অধিক সংবেদনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে এই ঋণ দেবে এআইআইবি।
ইআরডি সচিব শরিফা খান এবং বেইজিংভিত্তিক এআইআইবির ভাইস প্রেসিডেন্ট (বিনিয়োগ কার্যক্রম অঞ্চল-১) উরিজিৎ আর প্যাটেল চুক্তিতে সই করেন।
তিন বছরের রেয়াতকালসহ ২৬ বছর ৬ মাসে ৩ শতাংশ সুদে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে বলে জানায় ইআরডি।
এই বাজেট সহায়তা দিয়ে সরকার করোনা মহামারি থেকে নিম্ন আয়ের মানুষকে রক্ষা ও দক্ষতা বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ‘সামাজিক স্থিতিশীলতা কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে বলে জানিয়েছে ইআরডি।
এই কর্মসূচি দেশের সামাজিক উন্নয়নকে অধিক সংবেদনশীল করা, সুবিধা বঞ্চিতদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো এবং চাহিদা অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছে সরকার।
এই ২৫ কোটি ডলার পাওয়া গেলে প্রথমবারের মতো এআইআইবির কাছ থেকে বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলার ছাড়িয়ে যাবে। ২০১৬ সালে এআইআইবির সদস্য হওয়ার পর এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ৮০ কোটি ডলার পেয়েছে।
২০১৬ সালে কার্যক্রম শুরু করা এআইআইবি এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে ২৭৯ কোটি ডলারের চুক্তি করেছে বলে জানায় ইআরডি।
এর মধ্যে গত তিন বছরে ১০৫ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা রয়েছে, যা দিয়ে করোনা মহামারি মোকাবিলা ও কোভিড-পরবর্তী অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির ধারা ধরে রাখতে ব্যয় করা হয়।
আড়াই বছরের করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। এই চাপ সামাল দিতে সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ৪৫০ কোটি (৪.৫ বিলিয়ন) ডলার, বিশ্বব্যাংকের কাছে ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলার এবং এডিবির কাছে ১ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা চেয়েছিল। এ ছাড়া জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা-জাইকা এবং এআইআইবির কাছে ঋণ সহায়তা চেয়েছিল বাংলাদেশ।
এর মধ্যে আইএমএফের বহুল প্রতীক্ষিত সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের বিষয়ে সুসংবাদ পাওয়া গেছে। ফেব্রুয়ারির মধ্যেই এই ঋণের প্রথম কিস্তির অর্থ পাবে সরকার। বিশ্ব আর্থিক খাতের আরেক মোড়ল সংস্থা বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণের ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এডিবির ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে আলোচনার জন্য সংস্থটির ভাইস প্রেসিডেন্ট অশোক লাভাসা এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন।
এডিবি ঢাকা অফিসের বহিঃসম্পর্ক বিভাগের প্রধান গোবিন্দ বর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভাইস প্রেসিডেন্ট ঢাকায় অবস্থানকালে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীসহ নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। বৈঠকে বাংলাদেশ সরকার এডিবির কাছে বাজেট সহায়তা হিসেবে যে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছিল, সে বিষয়ে আলোচনা হবে। সফর শেষে ম্যানিলায় ফিরে গিয়ে এডিবি সদর দপ্তরে রিপোর্ট করবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। তারপর সংস্থার বোর্ডসভায় এই ঋণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।’
আড়াই বছরের করোনাভাইরাস মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় তছনছ হয়ে গেছে বিশ্ব অর্থনীতি। ওলটপালট হয়ে গেছে সব হিসাব-নিকাশ, যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। আমদানি বাড়ায় এবং রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কমায় রিজার্ভ কমছেই; বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) ঘাটতি বাড়ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি বেশ কমেছে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সও ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। কিন্তু এর পরও ব্যালান্স অফ পেমেন্টে বড় ঘাটতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫০ কোটি (৪.৫ বিলিয়ন) ডলার।
এই কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতেই সরকার দাতা সংস্থাগুলোর কাছে ঋণ চেয়েছিল।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের একজন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আইএমএফ ঋণ দেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর এখন অন্য সব দাতা সংস্থাও বাংলাদেশকে ঋণ দিতে চাইবে- এটিই স্বাভাবিক। কেননা ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে যেকোনো উন্নয়ন সংস্থা বা দাতা দেশ আইএমএফের মূল্যায়নকে একটি মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে। আইএমএফ যেহেতু আমাদের ঋণ দিচ্ছে, এখন বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ অন্য সব দাতা সংস্থা ও দেশ বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়াবে। আমরা এখন করোনার মতো যুদ্ধের ধাক্কাও দ্রুত সামলে উঠতে পারব।’
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আইএমএফ ঋণ দেয়ার ঘোষণার পর থেকেই সরকার স্বস্তির মধ্যে রয়েছে। সংকট মোকাবিলা করার সাহসও পাচ্ছে। এরই মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক আমদানি ব্যয় অর্ধেকে নেমে এসেছে। নভেম্বরে রপ্তানি আয়ে রেকর্ড হয়েছে; ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি এসেছে। রেমিট্যান্সও কিছুটা বেড়েছে। এ অবস্থায় আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি ফেব্রুয়ারিতে চলে এলে, এর মধ্যে এআইআইবি বিশ্বব্যাংক ও এডিবির ঋণও যদি পাওয়া যায়, সরকারের সংকট মোকাবিলা করা সহজ হবে। ২০২৩ সালকে নিয়ে যতটা ভয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তা আর মনে হয় থাকবে না।’