বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অর্থনীতি ভালো না থাকলে কর বাড়বে না

  •    
  • ৩ ডিসেম্বর, ২০২২ ০৮:১৯

দিন দিন কর দেয়া সহজ করা হচ্ছে। নিয়ম পরিবর্তন হচ্ছে। সারা বিশ্বে যেটা হয়ে থাকে। সারা বছর সবাই কর দেয়। আমাদের দেশেও কিন্তু তা-ই হয়। যে যখন বেতন পাচ্ছে তখন কর কেটে নেয়া হচ্ছে। ব্যাংক থেকে বেতন কেটে নেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে এখন এ রকম হচ্ছে। বছর শেষে সেগুলো সব একত্র করা হয়। আমি কত দিয়েছি সেটার প্রমাণ দিতে হবে। কতটা দিতে হবে সেটার কাগজ দিব। এসব কারণে একটি রিটার্ন দেয়ার প্রভিশনটা আছে।

প্রত্যাশা অনুযায়ী রিটার্ন জমা না পড়ায় ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের বার্ষিক আয়কর রিটার্ন জমার সময় এক মাস বাড়িয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর। এখন ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করদাতারা তাদের রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। যৌক্তিক কারণ ছাড়া এই সময় বাড়ানো যুক্তিযুক্ত হয়নি বলে মনে করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। তিনি বলেছেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অর্থনীতি ভালো থাকলে কর বাড়ে। আর অর্থনীতি ভালো না থাকলে কর আহরণ বাড়বে না।’

গত বৃহস্পতিবার নিউজবাংলাকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন সাবেক সচিব মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিউজবাংলার বিজনেস এডিটর আবদুর রহিম হারমাছি।

এবারও আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার সময় এক মাস বাড়ানো হয়েছে। প্রায় প্রতিবারই এই সময় বাড়ানো হয়। এই সময় বাড়ানোকে আপনি কতটা যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন।

দিন দিন কর দেয়া সহজ করা হচ্ছে। নিয়ম পরিবর্তন হচ্ছে। সারা বিশ্বে যেটা হয়ে থাকে। সারা বছর সবাই কর দেয়। আমাদের দেশেও কিন্তু তা-ই হয়। যে যখন বেতন পাচ্ছে তখন কর কেটে নেয়া হচ্ছে। ব্যাংক থেকে বেতন কেটে নেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে এখন এ রকম হচ্ছে। বছর শেষে সেগুলো সব একত্র করা হয়। আমি কত দিয়েছি সেটার প্রমাণ দিতে হবে। কতটা দিতে হবে সেটার কাগজ দিব। এসব কারণে একটি রিটার্ন দেয়ার প্রভিশনটা আছে।

অতীতে নিয়ম ছিল হিসাব বছর শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে এই রিটার্ন দিতে হবে। কাগজপত্র জোগাড় করতে যতটা সময় লাগে। এখন যে করটা দেয়া হচ্ছে সেটা গত বছর জুন মাস পর্যন্ত। সময় যতই বাড়ুক এটা কিন্তু জুন মাস পর্যন্তই থাকবে। এই বাড়তি সময়টা সবসময় তিন মাস ছিল। ব্রিটিশ আমল থেকেই তাই। সরকার ২০১০ বা ২০১১ সালের দিকে এটাকে পরিবর্তন করে এটাকে নভেম্বরে নিয়ে গেলেন। অর্থাৎ পাঁচ মাস। কেউ কেউ পারে না এই জন্য। আমি না পারার বিষয়টিকে এভাবে দেখি। এখন যেখানে অনলাইন করা হচ্ছে, ফরম যেখানে সহজ করা হচ্ছে। আমার হিসাব যেহেতু গত জুন মাসের হিসাব। আমি যখন এত সহজ করছি, সেখানে কেন আমাকে পাঁচ মাস সময় দিতে হবে। এর থেকে আসলে বের হয়ে আসা উচিত।

একটি কারণ থাকতে পারে। একটি পরিপত্র জারি করে এনবিআর সেটার জন্য মনে হয় দেরি করতে হয়। সেখানে লেখা থাকে ব্যাখ্যাটা কীভাবে দিচ্ছেন। সেটা আর কিছু না। ব্যাখ্যাটা জারি করতে যদি বিলম্ব হয়। সম্ভবত এটার বিলম্ব হয় বলে তারা পিছিয়ে। তাদের কাজের একটি গতির জন্য পিছিয়ে নভেম্বরে নিয়ে গেছে। কিন্তু এখানে একটি সমন্বয়ের দরকার ছিল। এই ব্যাখ্যাগুলো জুলাই বা আগস্ট মাসের মধ্যে দিতে হবে। তাহলে অর্থবিলে কী লিখেছি। সেটা না করে আমরা মুসাবেদি করতে থাকব। এখন থেকে সবাই আবার বাস্তবায়ন করবে। ব্যাখ্যা কিন্তু বারবার পরিবর্তন করা উচিত না। আর যেহেতু ব্যবসা বারবার পরিবর্তন করা হচ্ছে।

গত বছর করোনা মহামারির কারণে সময় বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু এবার তেমনটি নেই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলেছে, ব্যবসায়ীদের দাবির কারণে সময় বাড়ানো হয়েছে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?

এ বছর এমন কিছু ঘটে নাই যে, আরও এক মাস বাড়িয়ে দিতে হবে। বারবার সময় বাড়ানোয় কিন্তু এটা দেখা যাচ্ছে যে, সরকারের ম্যাক্রো ইকোনমিক ম্যানেজমেন্টে একটি জটিলতা তৈরি হচ্ছে। যে টাকা আমি যত তাড়াতাড়ি পেতাম প্রত্যক্ষ করে। প্রত্যক্ষ কর হচ্ছে সরকারের সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস। এটা সরাসরি পায় সরকার। এই আয়টা দিতে যদি বিলম্ব হয়, আমি যেই টাকা সেপ্টেম্বরে পেতাম, সেই টাকা নভেম্বরে আসে বা ডিসেম্বর মাসে আসে। তাতে কী হলো অর্থবছরের ছয় মাস আমি পিছিয়ে গেলাম। তাহলে এই ছয় মাস আমার চলবে কী করে।

কথা ছিল সেপ্টেম্বরে আমি যেই টাকা পাব সেই টাকা দিয়ে আমি ব্যয় করব। কিন্তু আমার টাকা পেতে যদি বিলম্ব হয় তাহলে ব্যাংকে আমার ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। জিনিসটা ওই ভাবে দেখতে হবে। আমি তো এখন সমস্যা খুব বেশি দেখি না। কারণ আমরা তো সব বিষয় সহজ করছি। সারা বছর আপনি কর দিচ্ছেন। সামনে এমন হবে যদি সব অনলাইন হয়ে যায়। এরপর আমাদের রিটার্ন দিতে সময় লাগার কথা না। ব্যাংক থেকে যেটা কেটে নিচ্ছে সেটা নিয়ে যাব। আমার সিস্টেম বলে দেবে ৫৪৫ টাকা ওনার জমা হয়েছে। এখন যে কাগজ টাকা জমা দিতে হয় তখন সেটা থাকবে না। যেখানে আমরা সহজীকরণের দিকে যাচ্ছি। সময় বাড়ানোটা যুক্তিযুক্ত না বলে আমি মনে করি।

বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। অর্থনীতির আকার বাড়ছে। কিন্তু ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম; ৯ শতাংশ। এই অনুপাত নেপালের চেয়েও কম। সরকারও ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর কথা বলছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু বাড়ছে না কেনো?

ট্যাক্স (কর)-জিডিপি রেশিও বা অনুপাত দেশের অর্থনীতি বোঝার একটি বড় মাধ্যম। কর-জিডিপি রেশিও দেখে বোঝা যায়, একটি দেশের জিডিপি গ্রোথ (প্রবৃদ্ধি) ভালো হয়েছে কি না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই রেশিও বিভিন্ন রকম। এই রেশিও সাধারণত ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ হতে পারে। অর্থাৎ ১০০ টাকা আয় হলে ১৫ থেকে ১৬ টাকা কর হবে। ১৬-১৭ টাকা হলে বলা যায় অর্থনীতিতে সব লোক কর দিচ্ছে। এডিপি (সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) বাস্তবায়নের সঙ্গে করের একটি বাস্তবতা বোঝা যায়।

কিন্তু আমাদের দেশে সেটা ব্যতিক্রম, এটা ৯ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে পাক খাচ্ছে। আমাদের জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ কর সরকার পাচ্ছে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই ঘাটতি? এই ঘাটতি দূর করার উপায়টা কী? আমার বিবেচনায় তিনটি কারণে এই ঘাটতি হচ্ছে। একটি হচ্ছে, সব লোক কর দেয় না। সবই করছে, কিন্তু কর দিচ্ছে না। গাড়ি ২৫ টার যায়গায় ৫০টা কিনছে, কর দিচ্ছে না। তার চালচলন দেখলে মনে হয় না তিনি গরিব। কিন্তু কর দেয়ার বেলায় তিনি গরিব। তার কাছে যাওয়া যাচ্ছে না। অথচ অর্থনীতি বাড়ছে; ৩ হাজার ডলার হয়েছে আমাদের পার ক্যাপিটা ইনকাম (মাথাপিছু আয়)। ৩ হাজার ডলার যদি পার ক্যাপিটা ইনকাম হয়, তাহলে আপনি কর দেন না কেন? কিন্তু আসলে তা না; বাস্তব সত্যটা হচ্ছে, সব লোকের মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলার বাড়েনি।

আসলে কিছু লোকের এত বেশি বেড়েছে যে, এভারেজ করতে গিয়ে ৩ হাজার হয়েছে। যার বেশি বেড়েছে তার বেশি কর দেয়ার কথা। যেহেতু আমার করের বেজ বাড়ে নাই লোকেরা কর দেয় না। আমাদের সমাজকে সেইভাবে তৈরি করতে হবে মানুষ যেন কর না দিয়ে থাকতে না পারে। আর করদাতার প্রত্যাশা থাকবে, যে কর আমি দিচ্ছি সেটা স্বচ্ছতার সঙ্গে যাচ্ছে, দেশের কাজে ব্যবহার হচ্ছে। তাহলে না দেশের মানুষ কর দিতে উদ্বুদ্ধ হবে। কর না দিতে পারার মধ্যে এখানে অনেকগুলো লুপহোলস (ফাঁক) রয়ে গেছে। এখানে একটি সাইকোলজিক্যাল ডিফারেন্স রয়ে গেছে।

ট্যাক্স-জিপিডি অনুপাত না বাড়ার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, জিডিপি বাড়ছে; জিডিপির সেই বড় খরচের ওপরে আপনি কর অব্যাহতি দিয়ে দিচ্ছেন, রেয়াত দিয়ে দিচ্ছেন। বড় আমদানি করছেন, আপনি কর মুক্তি দিয়ে দিচ্ছেন। কর মুক্তির ক্ষেত্রে আপনার একটি হিসাব থাকবে। যে মাল আনবে তাকে তো একটি হিসাব দেখাতে হবে। কর নেয়া হয় সবকিছু হিসাব-নিকাশের মধ্যে রাখার জন্য।

যদি আমি বলি যে, কর দিতে হবে না। তাহলে তো হিসাব থাকবে না। ৫টি জিনিস আনার কথা ছিল ৩টি জিনিস আনবে আর দুটো বিদেশে বিক্রি করে দেবে। যদি নিয়ম থাকত আপনি পাঁচটি জিনিস আনবেন একটি হিসাব হবে। টাকাটা তো সরকারকেই দিতে হবে। সরকারের এই পকেটের টাকা এই পকেটে যাবে। এখানে কর থাকা দরকার স্বচ্ছতার কারণে, প্রতিযোগিতার কারণে। আমি বলতি পারি যে, তুমি এই জিনিসটা আনো তোমার কর বেশি হবে না জাতীয় স্বার্থে। আরেকজন লোক ঠিকই কর দিয়ে সেই জিনিসটা আনছে। যে কর দিচ্ছে তার উৎপাদন ব্যায় কত হচ্ছে। আর যে কর দিচ্ছে না তার উৎপাদন ব্যয় কত হচ্ছে।

তখন কী হয়। তখন অর্থনীতিতে একটি বৈষম্য তৈরি হয়। আমরা এখন দেখছি সরকার বিশেষভাবে অর্থনৈতিক অঞ্চল বানাচ্ছে। বানিয়ে সেখানে জমির মূল্যসহ অন্য সবকিছুর দাম এক রকম রাখছে। আর অন্যদিকে প্রাইভেট সেক্টর ইউটিলিটি বিলটিল সব কিছু দিয়ে একটি জিনিস বানাচ্ছে। এখানকার খরচ বেশি হবে। বিদেশিরা কার কাছে আসবে। আপনি প্রতিযোগী তৈরি করছেন। একদিকে আপনি কর না দিতে বলছেন। অন্যদিকে কর দিতে বলছেন। এসব কারণে রেয়াত দেয়ার বিষয়টি অবশ্যই পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। কারণ, এতে হিসাবটা মিলছে না। বিনিয়োগ হচ্ছে, জিডিপি বাড়ছে। কিন্তু কর আসছে না। স্বচ্ছতার জন্য করের হিসাব রাখা উচিত। আপনি যখন একটি সেতু করমুক্তভাবে বানাবেন। তখন আপনি যে টোল আদায় করবেন, সেখানে যদি করটা না ধরেন তাহলে তো সামঞ্জস্যপূর্ণ হলো না। আপনি যদি মনে করেন, এখানে করের টাকা রাখব না। সেটা তো হলো না। আপনি মূল্যকে ছাপিয়ে রাখলেন। অথচ টাকা আপনার খরচ হয়েছে।

আরকর কম হওয়ার তৃতীয় কারণ হচ্ছে, যে কর আহরণ করে আর যে কর দেয় এদের মধ্যে সম্পর্ক। এই সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ, সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক নয়। আইনগুলোকে আরও জনবান্ধব করা দরকার। যারা কর আহরণ করে তাদের দক্ষতা ও স্বক্ষমতা বাড়াতে হবে। কর কর্মকর্তারা সব জায়গায় যেতে পারছে না। সব জায়গায় যাওয়া দরকার। উপজেলা অফিস থাকা দরকার। তার দক্ষ জনবল থাকা দরকার।

করদাতা যদি লোক রাখে এফসিএ পাস। তার সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য সেই রকম দক্ষ জনবল লাগবে। কর আহরণকারীকে দক্ষতা-স্বক্ষমতা অর্জন করতে হবে। একই সঙ্গে করদাতাকেও কর দিতে আন্তরিক হতে হবে। মনে রাখতে হবে, তার দেয়া করেই দেশ চলবে; রাস্তাঘাট হবে, সেতু হবে, হাসপাতাল হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে সরকার। যে সবের সুবিধা দেশের সকল মানুষ পাবে; দেশ আরও এগিয়ে যাবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সবশেষ হিসাবে দেশে টিআইএনধারী (কর শণাক্তকরণ নম্বর) করদাতার সংখ্যা ৮২ লাখের বেশি। কিন্তু কর দেন ২৫ লাখের মতো। টিআইএনধারী সবাই যাতে কর দিতে বাধ্য হয়, সেজন্য কী ব্যবস্থা নেয়া উচিত?

এখানেই আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। সব করদাতা কর দিতে আসছেন না বা কর দিচ্ছেন না। ৮২ লাখ করদাতার মধ্যে একটি বড় অংশ হচ্ছে সরকারি আর বেসরকারি কর্মজীবী। এই করদাতারা তো নামেই শুধু করদাতা। এদের বেতন থেকে খুব বেশি টাকা আসে না। যারা ভালো কর দেয়ার কথা, গাড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়ান। তিনি কিন্তু আসছেন না; কর দিচ্ছেন না। যারা দিচ্ছেন, যে পরিমাণ কর দেয়ার কথা তা দিচ্ছেন না। অর্থাৎ কর ফাঁকি দিচ্ছেন। সুতরাং এখানে দুপক্ষেরই দায়িত্ব পালন করতে হবে। যিনি টিআইএন খুলেছেন, তাকে অবশ্যই রিটার্ন সাবমিট (জমা) করতে হবে। অন্যদিকে এনবিআর যার টিআইএন খুলে দিয়েছে, তিনি কেন রিটার্ন জমা দিচ্ছেন না সেটাও ভালোভাবে খোঁজখবর রাখতে হবে। সব টিআইএনধারী যাতে রিটার্ন সাবমিট করে সেটা বাধ্য করতে হবে।

এখন টিআইএন খুলেছেন কিন্তু রিটার্ন জমা দিচ্ছেন না। এখন রিটার্ন জমা না দিলে উনি প্রমাণ করবেন কী করে যে, ওনার কর হয় কি হয় না। আমি রিটার্ন দিলাম না। আমি বুঝতে পারব না আমার সাড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আয় না কি। আমার কত শতাংশ কর হবে, এখন না দিলে কী হবে- এ বিষয়গুলো দুই পক্ষকেই অনুধাবন করতে হবে। একজন টিআইএন খুলেছেন, রিটার্ন দিচ্ছেন না, অথচ তিনি করের আওতায় পড়েন। তার বিরুদ্ধে সরকার কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারেন- এ বিষয়গুলো মানুষকে পরিষ্কার করে বোঝাতে হবে।

আমি আবার বলছি, করদাতা আর কর আরোহণকারীর (কর কর্মকর্তা) সংস্কৃতি যদি উন্নতি না হয়, তাহলে কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব না। করদাতা তিনি নিজের দায়িত্বে টিআইএন খুলবেন, রিটার্ন সাবমিট করবেন; তার দায়িত্ব তিনি পালন করবেন। আর কর আহরণকারীর কাজ হচ্ছে দেখা যে, করদাতা সঠিকভাবে এটা দিচ্ছেন কি না। তার বুঝতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না। সেটা ফেসিলিটেট করা। প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডেকে ডেকে এনে করদাতা বানানো এটা সমীচীন নয়। কাউকে তার দায়িত্ব পালনের জন্য বাধ্য করা, এই এনফোর্সমেন্টের দায়িত্ব এনবিআরের একার না। এটা হচ্ছে সমাজের, এনফোর্সমেন্ট।

করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য গতবার ৩৮ থেকে ৩৯টা খাতে বলা হয়েছিল যে, আপকি কর দিচ্ছেন কি না? এটার প্রমাণ দিতে হবে। আমার মনে হয়, এটার একটি ফল আসবে। সেদিন দেখলাম, এক জায়গায় একজন পরিচালক হতে গিয়েছেন। সেখান থেকে তাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে তার টিআইএন আছে কি না। এ রকম ভাবে সব জায়গা থেকে যদি চাওয়া হয় তাহলে এটার পরিবর্তন হবে। একটি চাপ সৃষ্টি হবে। যেমন- ব্যাংকে যত লোকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে তাদের উচিত রিটর্ন সাবমিট করা।

ব্যাংক জানে গ্রাহকের রিটার্ন নাই কিন্তু তারা ব্যাংক সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এখন ব্যাংককে বাধ্য করা হচ্ছে। এর আগে ব্যাংকের মাধ্যমে একটি চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। এখন বলা হচ্ছে, শুধু টিআইএন থাকলে হবে না। রিটার্ন দিয়েছে কি না সেটা দেখাতে হবে। এর একটি ফল পাওয়া যাবে বলে আমি মনে করি।

তাহলে কি আমরা আশা করতে পারি আগামীতে দেশে করদাতার সংখ্যা বাড়বে, ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত বাড়বে?

করের অঙ্ক কিন্তু প্রতিবছরই কমবেশি বাড়ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, একটি সভ্য নাগরিক সমাজকে এ রকমভাবে কর দেয়াতে হচ্ছে। এ রকম হওয়ার কথা ছিল না। আমরা একটি ট্রানজিশনে আছি। এটা বুঝতে হবে। সবকিছু এক দিনে হয়ে যাবে এটা ঠিক না। সবগুলো পদ্ধতিকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে করদাতা বাড়াতে হবে। এসব প্রচেষ্টা কন্টিনিউয়াসলি করে যেতে হবে। এ বছর করলাম, দ্বিতীয় বছর আর খেয়াল করলাম না- এটা হবে না। আমাদের মজ্জাগত সংস্কৃতির মধ্যে এটা আনতে হবে।

এটা ঠিক যে, সব লোক টিআইএন খোলে না, এটাও ঠিক যারা টিন খুলেছেন তারা রিটার্ন দিচ্ছেন না। যারা দিচ্ছেন তা সঠিক পরিমাণে দিচ্ছেন না। আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ তিনটা- সবাই যাতে টিআইএন খুলে সেটা একটি চ্যালেঞ্জ। যারা টিন খুলেছেন তারা যাতে রিটার্ন দেন সেটা একটা চ্যালেঞ্জ। আর যারা রিটার্ন দেন, তারা সঠিক দেন কি না সেটা আরেকটা চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে এনবিআরের দায়িত্ব তো আছে। তবে বেশি দায়িত্ব এই পক্ষের, মানে করদাতার। যিনি টিআইএন খুলেছেন তিনি যাতে রিটার্ন দেন।

সামাজিকভাবে আসতে হবে। জনগণকে বুঝতে হবে আমি যদি রাষ্ট্রকে কর না দিই তাহলে সরকার কোথা থেকে টাকাটা পাবে। না হলে তো সরকারকে ধারকর্জ (ঋণ) করতে হবে। ধারকর্জ করলে আমার সন্তানকে এটা শোধ করতে হবে। এই বোধ সবার মধ্যে এলে এই সমস্যা আর থাকবে না। সংস্কৃতিকে উন্নত করতে হবে। সব পক্ষকে সহমত পোষণ করে, সহযোগিতার দৃষ্টিতে সবাইকে জাতীয় স্বার্থে, দেশের স্বার্থে সহযোগিতা করতে হবে।

এই যে নিজস্ব অর্থে আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু তৈরি হয়েছে, আপনি গর্ব করে বলতে পারছেন যে, আমার টাকা সেখানে আছে। যদি কেউ এমন মনে করে যে, আমার টাকা না আমি সেই সেতুর ওপর দিয়ে যাতায়াত করছি; করছি তো করছি। কিন্তু এটা তো ঠিক হলো না।

করোনা মহামারির মধ্যেও গত অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে ১৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) হিসাবে সেই ইতিবাচক ধারা অব্যহত আছে। কিন্তু চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব রাজস্ব আদায়ে পড়বে কী?

অবশ্যই পড়বে। কারণ আমদানি-রপ্তানি রাজস্বের একটি বড় খাত। গত বছর কিন্তু আমদানি-রপ্তানি ভলিউম বাড়েনি। দাম বেড়ে গিয়েছিল, সেই কারণে আমদানি বেড়েছিল। রপ্তানিও কিন্তু পরিমাণের দিক দিয়ে বাড়েনি। বেড়েছিল দামের জন্য। যেহেতু আমদানিতে আগের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ খরচ হয়েছিল, তার থেকে আমদানি শুল্কসহ অন্যান্য কর মিলিয়ে সরকারও বেশি ট্যাক্স পেয়েছিল।

একইভাবে রপ্তানি আয়েও টাকার অঙ্কে বড় উল্লম্ফন হয়েছিল, সে কারণে এ খাত থেকেও বেশি কর পেয়েছিল সরকার। কিন্তু যুদ্ধের কারণে এবার সরকার ব্যয় সংকোচনের পথ বেছে নিয়েছে। যার ফলে আমদানি অনেক কমে গেছে। অন্যদিকে যুদ্ধের কারণে দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। সে কারণে রপ্তানিতেও মন্থর গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এবার এই দুই খাত থেকে কর আদায় খুব একটা বাড়বে বলে মনে হয় না।

এগুলোর চেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমাদের অর্থনীতিতে একটি বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। আমরা যে রেভিনিউ আয় করি এর একটি বড় উদ্দেশ্য আয়বৈষম্য কমানো। যার বেশি আয় হচ্ছে, সেখান থেকে নিয়ে যার আয় কম তাকে দেয়া। এটা হচ্ছে রেভিনিউ বাড়ানোর একটি বড় উদ্দেশ্য। আমরা আয়বৈষম্য কমাতে পারছি না। এখানে গলদ দেখা যাচ্ছে। ব্যাংক থেকে টাকা চলে যাচ্ছে। সেই টাকার ওপরে আমি কোন কর নিতে পারছি না। ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে; সবশেষ হিসাবে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তার মানে এই বিশাল অঙ্কের টাকা থেকে আমি কোনো কর পাচ্ছি না।

এই টাকা বিনিয়োগ হলে, ব্যবহার হলে আমি ভ্যাট পেতাম, আমি সেটা পাচ্ছি না। এই টাকা যিনি নিচ্ছেন তিনি কর দিচ্ছেন না। সুতরাং অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা-অস্পষ্টতা এই একটা পরিস্থিতি। এটা কর আহরণের ওপরে বড় প্রভাব ফেলছে। আমরা বলি অর্থনীতি ভালো থাকলে কর বাড়বে। অর্থনীতি ভারো না থাকলে কর আহরণ বাড়বে না। যে টাকাগুলো পাচার হয়ে যাচ্ছে, সে টাকাগুলো বিনিয়োগ হলে আমরা অনেক কর পেতাম, ভ্যাট পেতাম। কেনাকাটা হতো আমি ভ্যাট পেতাম। এই টাকা দিয়ে কারখানা হতো। ব্যবসা বাণিজ্য হতো। দেশে কর্মসংস্থান হতো। অর্থনীতিতে আরও গতিসঞ্চার হতো।

সাম্প্রতিক সময়ে একটি বিষয় বেশ আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও বলছে, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অনেক টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

এই যে আমি এতক্ষণ বললাম, যাদের অনেক কর দেয়ার কথা তারা কর দিচ্ছেন না। অর্থাৎ ফাঁকি দিচ্ছেন। আবার অনেকে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ দিয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন না। ইচ্ছে করে খেলাপি হচ্ছেন। এই টাকাগুলোই বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। আর অর্থনীতির বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। এই টাকা দুর্নীতি করে নেয়া, সেখানেই একটি বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। বৈষম্য কমাতে এনবিআরের যে লক্ষ্য সেটা তো কাজ করছে না। সেই ফিলোসফি যখন কাজ করবে তখন এটা ঠিক হয়ে যাবে। এটা একটি চ্যালেঞ্জ।

তবে এটাও ঠিক যে, সব সময় এনবিআরকে দোষারোপ করলে হবে না। দেখতে হবে অর্থনীতি সুস্থ আছে কি না? মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। কমে গেছে বলেই সে আগের মতো পণ্য কিনছে না। চাহিদা কমে গেছে। সে কারণে উৎপাদনও কম করছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। একটার সঙ্গে একটি সম্পর্কিত কিন্তু। প্রান্তিক মানুষের কাছে টাকা নেই। আপেলের দাম অনেক বেড়ে গেছে, ৪০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। যাদের কাছে টাকা আছে তারা কিনছেন। এর কারণে চাহিদা কমে যাচ্ছে।

তবে আমি মনে করি, শুধু করোনাভাইরাস বা বৈদেশিক বিনিয়োগ এসব কথা বললে হবে না। আমাদের যা সক্ষমতা আছে, সেটার যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে। মানুষ যে ব্যাংকে টাকা জমা দেয় নিজের টাকা বাঁচানোর জন্য। এমনভাবে জমা দেয় যাতে টাকা মূল্যস্ফীতি থেকে বেঁচে যায়। এখন দেখা যাচ্ছে, বাইরে ইনফ্লেশন ৯ শতাংশ, ব্যাংক আমাকে দেয় ৬ শতাংশ। আমার টাকা কমে যাচ্ছে। আমি যখন দেখি যে টাকার নিরাপত্তা নাই। এই টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। তখন আমার অবস্থাটা কী হয়। এই বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধাকদের অনুধাবন করতে হবে।

এ বিভাগের আরো খবর