বৈদেশিক বাণিজ্যে পণ্যের দাম কম বা বেশি দেখিয়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ‘ট্রেড বেজড’ মানি লন্ডারিং (অর্থ পাচার) বন্ধ হবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
তিনি বলেছেন, ‘আশ্চর্যজনকভাবে দেখলাম যে ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত ওভার ইনভয়েসিং (অতিরিক্ত মূল্য দেখানো) করে পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এ রকম ১০০ এলসি বন্ধ করেছি আমরা।’
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে গভর্নর এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিআরআই-এর ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ।
সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য ‘পোস্ট কোভিড ইন এন ইউক্রেন অ্যান্ড ডিসিসিভ ওয়ার্ল্ড’।
সম্প্রতি আমদানি বাণিজ্য বৃদ্ধির বিপরীতে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স সেভাবে বাড়েনি। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপে পড়েছে বাংলাদেশ। আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত বছরের আগস্টে থাকা ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ বুধবার পর্যন্ত ৩৩ দশমিক ৮৬ বিলিয়নে নেমে এসেছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমদানি নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি বছরের শুরুতেও গড়ে প্রতি মাসে ৮ বিলিয়নের উপরে আমদানি হয়েছে। অক্টোবরে তা চার বিলিয়নের ঘরে নামিয়ে এনেছে সরকার।
বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে এলসি খুলতে দেয়া হচ্ছে না ব্যবসায়ীদের- এমন অভিযোগের বিষয়ে গভর্নর বলেন, ‘এটি সত্য নয়। আমরা কোনো এলসি বন্ধ করিনি। আমরা প্রাইস কন্ট্রোল (মূল্য নিয়ন্ত্রণ) করছি, যাতে সঠিক দরে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি হয়। বিলাসী পণ্য আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে মাত্র। আপাতত বিলাসী পণ্য কম এলেও সমস্যা হবে না।’
আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘জুলাইয়ে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথমে আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং হচ্ছে কিনা তা দেখতে গত বছর ও এ বছরের অনেক এলসির তথ্য যাচাই-বাছাই শুরু করি। তখন আমরা দেখতে পেলাম ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত ওভার ইনভয়েসিং করে পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এরপর আন্ডার ইনভয়েসিং-এর তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘এক লাখ ডলার মূল্যের গাড়ি আমদানি করা হয়েছে মাত্র ২০ হাজার ডলারে। এতে বোঝা যায় বাকি অর্থ তারা হুন্ডির মাধ্যমে দিয়েছে। আর হুন্ডিতে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রবাসীদের না পাঠানো রেমিট্যান্স।
‘বর্তমানে অতিরিক্ত ও কম মূল্য দেখিয়ে করতে চাওয়া এলসি বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। পরবর্তীতে তা সংশোধন করে প্রকৃত দরে আমদানি করতে চাইলে এলসি করতে পারছেন ব্যবসায়ীরা।
‘আমরা আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের দর নিয়ে কাজ করছি, যাতে অর্থপাচার বন্ধ হয়।’
ঋণে বেঁধে দেয়া সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ ঋণ সুদ হার নিয়েও কথা বলেন গভর্নর। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের জন্য মেয়াদি ও চলতি মূলধনের ঋণ সুদ হার সীমা ৯ শতাংশ তুলে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু এখন তার সঠিক সময় নয়।’
গভর্নর বলেন, ‘সিএমএসএমই খাতে ব্যাংকগুলোকে ২ শতাংশ সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকে ঋণ নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এখন তারা কম সুদের তহবিল পাওয়ায় এ খাতে সুদ হার তুলে দেয়ার প্রয়োজন নেই।’
ডলারের দর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজার অনুযায়ী হওয়া উচিত। এখন তা বাজারে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এ কারণে খোলা বাজারে ১২১ টাকায় উঠে যাওয়া ডলার এখন ১১০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।’
গভর্নর বলেন, ‘রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার বড় কারণ হুন্ডি। এজন্য রেমিট্যান্স আনা সহজ করার পাশাপাশি আমদানিতে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধ করা হচ্ছে।’