সপ্তাহের প্রথম দুই কর্মদিবসে দরপতনের পর মঙ্গলবার সূচক বাড়লেও সেটি স্থায়ী হয়নি। চতুর্থ কর্মদিবসে ফের দরপতন দেখল পুঁজিবাজার। লেনদেন কিছুটা বাড়লেও আগের দিনের মতোই প্রায় তিন শ কোম্পানির শেয়ারের ক্রেতা খুঁজে মরেছেন বিনিয়োগকারীরা।
এসব কোম্পানির মধ্যে ৬৬টির শেয়ারের ক্রেতা ছিল না একজনও। ফ্লোর প্রাইসে ২৩০টি কোম্পানির শেয়ার হাতবদল হয়েছে নগণ্যসংখ্যক। এক কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে কেবল ৬৫ কোম্পানিতে, এক লাখ টাকার বেশি হাতবদল হওয়া এমন কোম্পানির সংখ্যা কেবল ১৬১টি।
আগের দিন কেবল ৬টি কোম্পানির শেয়ারের দর কমলেও বুধবার দর হারায় ৬৩টি। মঙ্গলবার দর বেড়েছিল ৭৮ কোম্পানির, সেই সংখ্যা কমে হয়েছে ২০।
এই দরপতনে সূচক কমেছে ২২ পয়েন্ট। সপ্তাহের প্রথম দুই দিন যথাক্রমে ৫০ ও ২৪ পয়েন্ট পতনের পর মঙ্গলবার ৩৯ পয়েন্ট পুনরুদ্ধার হয়েছিল।
ওরিয়ন গ্রুপ, বসুন্ধরা পেপার ছাড়া অন্য কাগজ কোম্পানি, ওষুধ ও রসায়ন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বেশ কয়েকটি এক দিনের বিরতি দিয়ে ফিরেছে পতনের ধারায়। গত ৩১ জুলাই ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর এসব কোম্পানির দর বাড়তে বাড়তে আকাশচুম্বী হয়ে যায়। সেখান থেকে পড়তে পড়তে কিছু কোম্পানি ফ্লোরে নেমেছে, কিছু কোম্পানি ফ্লোর থেকে এক দিনের পতনের দূরত্বে রয়ে গেছে। কিছু কোম্পানি আর কয়েকদিন দর হারালেই ফ্লোরে নামবে- এমন পরিস্থিতিতে।
তবে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে কোনো দিন আড়াই শ কোনো দিন তিন শ কোম্পানির শেয়ারের ক্রেতা মিলছে না। লাখ লাখ শেয়ার বিক্রির জন্য বসিয়ে রেখে দিন শেষে হতাশ হতে হচ্ছে বিনিয়োগকারীর। এর মধ্যে মৌলভিত্তির বহু কোম্পানি আছে, যেগুলো বছরের পর বছর ধরে বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণীয় লভ্যাংশ দিয়ে আসছে, অর্থনৈতিক সংকটেও বেশ ভালো মুনাফা করছে। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে পারছে না।
যে ফ্লোর প্রাইসের কারণে পুঁজিবাজারে সূচক ও শেয়ারদরের পতন ঠেকানো গিয়েছিল, সেটি এখন লেনদেনের বাধা হলেও যে আতঙ্ক বাজারে, তার কারণে এটি তুলে নেয়ার মতো সিদ্ধান্তও নেয়া যাচ্ছে না।
বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতিও আছে চাপে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আশা করা হচ্ছে আগামী জানুয়ারিতে মুক্তি মিলবে এই চাপ থেকে, তবে ফেসবুকে নানা গুজব, গুঞ্জনে কান দিয়ে উৎকণ্ঠিত হচ্ছে মানুষ।
এই অবস্থায় শেয়ার বিক্রি করতে না পারার কারণে লেনদেন আটকে আছে। তিন কর্মদিবস পর পাঁচ শ কোটি টাকার ঘর ছাড়ালেও চাঙা পুঁজিবাজারে এক ঘণ্টার লেনদেনও এখন হচ্ছে না সাড়ে চার ঘণ্টায়।
বুধবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের চিত্র
এমন একটি খাতও ছিল না, যেটি নিয়ে দিন ভালো গেছে। কোনো খাতে লেনদেন ছাড়ায়নি এক শ কোটির ঘর। শীর্ষে থাকা তথ্য প্রযুক্তি খাতে হাতবদল হয়েছে ৯৪ কোটি টাকা। টেলিযোগাযোগ খাতে বড় মূলধনি কোম্পানি গ্রামীণ ফোন ও রবি থাকার পরও লেনদেন হয়েছে কেবল ১০ লাখ টাকা। ব্যাংক খাতে লেনদেন চার কোটি টাকাও ছাড়াতে পারেনি।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন ৭৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা হাতবদল হয়েছে ওষুধ ও রসায়ন খাতে। প্রায় সম পরিমাণ লেনদেন হয়েছে কাগজ ও প্রকাশনায়। এছাড়া জীবন বিমায় হাতবদল হয়েছে ৪৮ কোটি টাকা।
কোন পথে উত্তরণ জানা নেই: সাবেক ডিবিএ সভাপতি
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সাবেক সভাপতি শরীফ আনোয়ার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, দেশে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা ইত্যাদি কারণে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। দিন দিন ইনভেস্টর কমছে, ইন করছে না।
‘তাদের মনোভাব- সবাই যখন কিনবে, তখন আমরা কিনব। এখন বিনিয়োগের সময় না। ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে আরও নিচে নামবে। তাহলে এখন কেন কিনব?’
তিনি বলেন, ‘যারা এতদিন নিজস্ব স্বকীয়তায়, বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বাজারে বিনিয়োগ করে এসেছেন তারা বিপদে পড়েছেন। তাদের অনেকের শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে। একজনের টাকা প্রয়োজন পড়লেও বিক্রি করে টাকা নিতে পারছেন না।
‘প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা কয়েকটা আইটেমে মুভ করছে বলেই লেনদেন চার শ কোটির ঘরে। সবাই যদি একটু করে কিনতো, তাহলেও এক হাজার কোটির নিচে লেনদেন হওয়ার কথা নয়।’
প্রাতিষ্ঠানিকদের বিনিয়োগ বাড়তে পারতো কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সেটা তো বলতে পারব না। কারণ, তারা কতটুকু বিনিয়োগ করছেন, তাদের কাছে কতটুকু টাকা আছে, সেটা বলা যাচ্ছে না।’
এর থেকে উত্তরণের পথ দেখছেন না ব্রোকারদের সাবেক এই নেতা। তিনি বলেন, ‘কোন ফর্মূলায় গেলে এই অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি মিলবে, তা বোঝা যাচ্ছে না।’
সূচকে ফেলল যারা
সবচেয়ে বেশি ২ দশমিক ২৪ পয়েন্ট সূচক কমেছে বিকন ফার্মার দরপতনে। কোম্পানিটির দর কমেছে ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২ দশমিক ০৯ পয়েন্ট কমেছে ওরিয়ন ফার্মার কারণে। শেয়ার প্রতি দাম কমেছে ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
ওরিয়ন ইনফিউশনের দর ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে ১ দশমিক ৮৩ পয়েন্ট।
এ ছাড়া অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, বেক্সিমকো ফার্মা, নাভানা ফার্মা, জেএমআই হসপিটাল, এডিএন টেলিকম, সি-পার্ল ও ইস্টার্ন হাউজিংয়ের দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ১৪ দশমিক ৫০ পয়েন্ট।
বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ১ দশমিক ৪০ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে স্কয়ার ফার্মা। এদিন শেয়ারটির দর বেড়েছে শূন্য দশমিক ৩৮ শতাংশ।
সোনালী পেপারের দর ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে শূন্য দশমিক ৭৫ পয়েন্ট।
অ্যাডভেন্ট ফার্মা সূচকে যোগ করেছে শূন্য দশমিক ৪১ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
এর বাইরে সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, বাটা সুজ, সোনালী আঁশ, প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ৪ দশমিক ৬৬ পয়েন্ট।
দরবৃদ্ধির শীর্ষ ১০
সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৯6 শতাংশ দর বেড়ে চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৫৯ টাকা ৬০ পয়সায়, যা আগের দিন ছিল ৫৪ টাকা ২০ পয়সা।
এরপরেই ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ বেড়ে অ্যাডভেন্ট ফার্মার শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২৪ টাকা ৮০ পয়সায়, যা আগের দিন ছিল ২২ টাকা ৬০ পয়সা।
তালিকার তৃতীয় স্থানে ছিল সোনালী আঁশ। ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ দর বেড়ে শেয়ারটি হাতবদল হয়েছে ৭৩১ টাকা ১০ পয়সায়। আগের দিনের দর ছিল ৬৮১ টাকা।
এ ছাড়াও শীর্ষ দশে থাকা বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের দর বেড়েছে ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ, মুন্নু অ্যাগ্রো ৪ দশমিক ০২ শতাংশ, প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স ৩ দশমিক ১৩ শতাংশ, রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স ১ দশমিক ৭০ শতাংশ, সোনালী পেপার ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ, বাটা সুজ ১ দশমিক ১৭ শতাংশ ও কে অ্যান্ড কিউয়ের দর বেড়েছে ১ দশমিক ০৭ শতাংশ।
দরপতনের শীর্ষ ১০
দরপতনের শীর্ষে রয়েছে এইচআর টেক্সটাইল। ৯ দশমিক ০৯ শতাংশ কমে শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ১১৫ টাকা ৯০ পয়সায়, আগের দিনে দর ছিল ১২৭ টাকা ৫০ পয়সা।
এডিএন টেলিকমের দর ৮ দশমিক ২৪ শতাংশ কমে শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৯৮ টাকায়, আগের দিন ক্লোজিং প্রাইস ছিল ১০৬ টাকা ৮০ পয়সা।
মনোস্পুলের দর কমেছে ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ। শেয়ার হাতবদল হয়েছে ২৫৫ টাকা ৫০ পয়সায়। আগের দিনে দর ছিল ২৭৫ টাকা ৫০ পয়সা।
এ ছাড়া শীর্ষ দশের মধ্যে জেমিনি সি ফুড, সিনোবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজ, নাভানা ফার্মা, ই-জেনারেশন ও ইস্টার্ন হাউজিংয়ের দর কমেছে ৬ শতাংশের বেশি।
ওরিয়ন ইনফিউশন ও জেএমআই হসপিটালের দর কমেছে ৫ শতাংশের বেশি।