‘বিভিন্ন খাতে কর অব্যাহতির নামে বছরে ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে। কর সুবিধা দেয়ার পেছনে স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মূল সমস্যা নেতৃত্ব বা লিডারশিপ।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক সদস্য ড. মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন শনিবার এক সেমিনারে এসব কথা বলেন।
‘প্রত্যক্ষ কর ও আয়-বৈষম্য’ শীর্ষক এই সেমিনারের আয়োজন করে অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম-ইআরএফ।
ড. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘রাজস্ব বিভাগকে গতিশীল করতে অনেক সংস্কার করা হলেও এর তেমন সুফল মেলেনি। কারণ, সংস্কারগুলো তেমন কার্যকর ও বাস্তবসম্মত ছিল না।
‘এনবিআরের মূল সমস্যা হচ্ছে নেতৃত্ব। এই সংস্থার লিডারশিপে দুর্বলতা আছে। কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় বাড়াতে হলে এবং এনবিআরকে স্বচ্ছ ও গতিশীল সংস্থায় পরিণত করতে হলে সংস্থার প্রশাসনিক কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আনতে হবে।’
অবসরপ্রাপ্ত এই সচিব মনে করেন, প্রত্যক্ষ কর, মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাট ও শুল্ক সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকলে এনবিআর পরিচালনা করা কঠিন। সে জন্য এই সংস্থায় পেশাদার ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রয়োজন।
রাজস্ব আদায় বাড়াতে ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কাস্টমস, ভ্যাট ও মূল্য সংযোজন কর বিভাগের পূর্ণাঙ্গ অটোমেশনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
রাজধানীর পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক।
ইআরএফ সভাপতি শারমিন রিনভীর সভাপতিত্বে সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইয়াজদানী খান এবং এনবিআর সদস্য (জরিপ ও পরিদর্শন) মাহমুদুর রহমান।
আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ। এ সময় ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক এ এস এম রাশিদুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনায় বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে অনেক উন্নতি হলেও দুটি ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। তা হলো আয় বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় সরকারি ব্যয় বা বাজেটে বরাদ্দ কম।
আয় বৈষম্য দূর করতে হলে আয়কর বা প্রত্যক্ষ কর বাড়াতেই হবে। পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে আয়কর আহরণের পরিমাণ জিডিপির তুলনায় মাত্র ৯ শতাংশ। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে কর-জিডিপি অনুপাত কমপক্ষে ১৭ শতাংশে উন্নীত করতে হবে বলে মত দেন বক্তারা।
আলোচকরা বলেন, বাংলাদেশে জিডিপি যে হারে বেড়েছে, কর আদায় সেভাবে বাড়েনি। এর কারণ, আমাদের কর-নেট সীমিত। বর্তমানে দেশে আয়কর আহরণের পরিমাণ মোট রাজস্ব আদায়ের ৩৫ শতাংশ। এটাকে ৫০ ভাগে উন্নীত করতে হবে। এর জন্য এনবিআরের কাঠামোগত ও নীতিগত সংস্কারে বেশি নজর দিতে হবে।
অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইয়াজদানী খান স্বীকার করেন, দেশে সরকারি ব্যয় কম। এর কারণ কর আদায় প্রত্যাশিত নয়। আমাদের অর্থনীতির যে আকার, তার সঙ্গে রাজস্ব আদায় সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এখানে অনেক ফারাক রয়েছে। এই ফারাক কমাতে হলে কর আহরণ বাড়ানোর বিকল্প নেই।
তিনি মনে করেন, অগ্রিম কর ব্যবস্থা পৃথিবীর সব দেশেই আছে এবং এটি একটি জনপ্রিয় ব্যবস্থা। বাংলাদেশে অগ্রিম কর নিয়ে সমালোচনা হয় এ কারণে যে, এখানে রিফান্ড বা ফেরত দেয়ার সংস্কৃতি ভালো নয়।
করদাতাদাদের সুবিধার্থে ট্যাক্স ফেয়ার সার্ভিস ইউনিটগুলোকে সক্রিয় ও সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ‘বাংলাদেশে অনেক বিদেশি উচ্চ বেতনে চাকরি করেন। তাদের সবাইকে কর নেটে আনতে পারলে আদায় আরও বাড়বে।
‘ফ্ল্যাট ও জমি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে প্রকৃত মূল্য গোপন করা হয়। এই খাতে সংস্কার করতে পারলে কর আদায় বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।’
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশে বর্তমানে যে পরিমাণ প্রত্যক্ষ বা আয়কর আদায় হয় তা জিডিপির ২ দশমিক ৬ শতাংশ। সমাজের সবচেয়ে গরিবরা যে আয় করে তার ৭ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যয় হয় ভ্যাটের পেছনে। অপরদিকে সমাজের সবচেয়ে ধনীরা ভ্যাটে খরচ করে মাত্র ১ শতাংশ। তার মানে ধনীর তুলনায় গরিবরা করের জালে বেশি আটকে আছে।
সামর্থ্যবান সবাইকে কর নেটে আনা সম্ভব হলে ব্যক্তি খাতে কর আদায় বাড়বে জিডিপির ৩ দশমিক ২ শতাংশ, যা এখন আছে মাত্র ১ শতাংশ।
প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে যে পরিমাণ করপোরেট ট্যাক্স আদায় হয় তা জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ। জয়েন্ট স্টক কোম্পানির হিসাব অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় সোয়া দুই লাখ। অথচ বার্ষিক রিটার্ন জমা দেয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোম্পানি। মাত্র ১৫ হাজার লোক সারচার্জ দেন।
র্যাপিড চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তির ৮৫ শতাংশ ইনফরমাল বা অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। এদের অনেকেরই কর দেয়ার সমর্থ্য আছে। অথচ তাদের বড় অংশই এখনও কর নেটের বাইরে। সামর্থ্যবান সবাইকে করের আওতায় আনা গেলে আয়কর আদায় আরও বাড়বে। আর কর আদায় বাড়লে আয়-বৈষম্যও কমে আসবে।’
কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে অব্যাহতির তালিকা পর্যালোচনার পরামর্শ দেন তিনি। একইসঙ্গে কর প্রশাসনকে কর নীতি থেকে আলাদা করার প্রস্তাব করেন তিনি।