জুতা তৈরিতে দেশসেরা ব্র্যান্ড এপেক্স ফুটওয়্যার বছরের পর বছর ধরে অস্বাভাবিক কম মুনাফার তথ্য দিয়ে যাচ্ছে।
গত জুনে সমাপ্ত অর্থবছর শেষে কোম্পানিটি আয়ের যে তথ্য জানিয়েছে, সেটি বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে করা একেকটি শোরুমে মাসে আয় হয় ৩৭ হাজার টাকার মতো।
কেবল তা-ই নয়, বিদেশে জুতা রপ্তানি করে বছরে সরকারের কাছ থেকে যে নগদ প্রণোদনা পায় কোম্পানিটির চূড়ান্ত আয় হিসেবে তার ১২ শতাংশ দেখানো হচ্ছে।
কোম্পানিটির রিজার্ভে যে টাকা আছে, সেটি খরচ না করে কেবল ব্যাংকে রাখলে সেখান থেকেও যে মুনাফা আসার কথা, সেটিও কোম্পানিটির দেখানো চূড়ান্ত মুনাফার চেয়ে বেশি। অবশ্য রিজার্ভের টাকা ব্যাংকে সঞ্চয় করে রাখা হয় এমন না। চলতি মূলধন হিসেবে বা কাঁচামাল কিনতেও এর ব্যবহার আছে।
কেবল তা-ই নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য কোম্পানিগুলোর তুলনায় প্রতি ১০০ টাকা বিক্রির বিপরীতে কোম্পানিটির প্রকৃত আয় এতটাই কম যে এপেক্সকে একটি সফল ব্যাবসায়িক উদ্যোগ হিসেবে বিবেচনা করাই কঠিন।
পুরো বিষয়গুলো জানালে হিসাববিজ্ঞান নিয়ে একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, অ্যাপেক্স যে আয়-ব্যয়ের হিসাব দিচ্ছে তা প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি কোম্পানিটির কর্মকর্তাদের কাছেও অনেক প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যায় না।
কোম্পানিটির উদ্যোক্তা দেশের প্রখ্যাত একজন ব্যবসায়ী সৈয়দ মনজুর এলাহী, যিনি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন।
শোরুমের আয় কত?
কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ১৯৯৩ সালে। এটির ব্যবসা মহানগর ছাড়িয়ে এখন জেলায় জেলায় পৌঁছে গেছে। এখন কোম্পানিটির সারা দেশে আড়াই শটির মতো শোরুম আছে।
গত অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি ৯ টাকা ৩৬ পয়সা হিসেবে কোম্পানিটি আয় করেছে ১১ কোটি ৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এই হিসাবে শোরুমপ্রতি বছরে আয় দাঁড়ায় ৪ লাখ ৪২ হাজার ২৬০ টাকা, মাসে দাঁড়ায় গড়ে ৩৬ হাজার ৮৫৫ টাকা।
বিপুল পরিমাণ ব্যয় করে এই আয় নগণ্য, সেটি বলাই বাহুল্য। তার পরও কোম্পানিটি বছর বছর শোরুম বাড়িয়েই চলেছে।
বিক্রির বিপরীতে নগণ্য আয়
২০১৭ থেকে ২০২১ সাল- এই পাঁচ বছরের মধ্যে ২০২০ সাল বাদ দিয়ে বাকি চার বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এপেক্স প্রতি ১০০ টাকা বিক্রির বিপরীতে মুনাফা দেখাচ্ছে ৭৬ পয়সা।
২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২১- এই চার বছরে এপেক্সের বিক্রি ছিল ৫ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা।
আর এই চার বছরে তারা মুনাফা দেখিয়েছে মাত্র ৪৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। মানে গড়ে প্রতি ১০০ টাকা বিক্রিতে মুনাফা দেখিয়েছে মাত্র ৭৬ পয়সা।
অর্থাৎ ৫ হাজার টাকার একটি জুতা বিক্রি করলে এপেক্স ফুটওয়্যারের আয় হয় ৩৮ টাকা মাত্র।
২০২০ সাল বাদ দেয়ার কারণ হচ্ছে এটি করোনার আঘাতে একটি অস্বাভাবিক বছর ছিল। ওই বছর সাধারণ ছুটিতে দীর্ঘ সময় আউটলেট বন্ধের কারণে বিক্রি ছিল কম। ফলে আয় হয় কম। সেই বছরটি হিসাবে ধরলে মূল প্রবণতা পাওয়া যেত না।
এপেক্স যে ১ শতাংশেরও কম মুনাফা দেখাচ্ছে, সেটি দেশের অন্য জুতা কোম্পানির তুলনায় অনেক কম।
কোম্পানিটির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বহুজাতিক কোম্পানি বাটা ১০০ টাকা বিক্রি করে মুনাফা দেখাচ্ছে ৭ টাকা ৩৬ পয়সা। সেটিও কম হয়েছে ২০২০ সালে বড় অঙ্কের লোকসানের কারণে। বাকি চার বছরে ১০০ টাকা বিক্রির বিপরীতে মুনাফা দাঁড়ায় ১২ টাকা ৬৮ পয়সা।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অপেক্ষাকৃত ছোট কোম্পানি ফরচুন সুজ প্রতি ১০০ টাকা বিক্রিতে মুনাফা দেখিয়েছে ১৫ টাকা ৫ পয়সা।
লিগ্যাসি ফুটওয়্যার গড়ে প্রতি ১০০ টাকা বিক্রিতে মুনাফা দেখিয়েছে ১১ টাকা ৯৬ পয়সা।
একজন হিসাব বিশেষজ্ঞ বলেছেন, একই খাতের কোম্পানির মুনাফার হারে এত পার্থক্য হতে পারে না। কারণ কোম্পানিগুলোর খরচের পরিমাণ একই রকম হয়। বরং বড় কোম্পানির খরচ তুলনামূলক কম।
এপেক্স ও অন্য জুতা কোম্পানির বিক্রির বিপরীতে আয়ের এই পার্থক্যের বিষয়টি জানানো হলে আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একই খাতের কোম্পানির মুনাফায় এত হেরফের এটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। এ রকম পার্থক্য হয় না। যেহেতু অ্যাপেক্সের উৎপাদন ও বিক্রি বেশি, তাই তাদের খরচ আরও কম হওয়ার কথা ছিল।’
বিনিয়োগে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে সিএফএ চার্টার্ড ডিগ্রিধারী এই পুঁজিবাজার বিশ্লেষক মনে করেন, এপেক্স ফুটওয়্যারের মুনাফার হার বাটা, লিগ্যাসি বা ফরচুনের তুলনায় আরও বেশি হওয়ার কথা ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক এম সাদিকুল ইসলাম বলেন, ‘একই খাতের কোম্পানির মুনাফার হারে এত পার্থক্য এটা একটু অস্বাভাবিক। হয়তো হতে পারে, তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।’
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি খুব দুঃখজনক। আমাদের দেশের নামিদামি উদ্যোক্তারা গত ২ দশক ধরে আয়-ব্যয়ের উল্টাপাল্টা হিসাব দেখিয়ে আসছেন। তারা বিনিয়োগকারীদের ঠকিয়ে আসছেন।’
খরচ অস্বাভাবিক বেশি
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী চারটি কোম্পানির মধ্যে এপেক্সের উৎপাদন খরচ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। অন্যান্য খরচও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এটির কারণে এপেক্সের মুনাফা দেখানো হয় কম।
আবার যে কোম্পানির উৎপাদন খরচ বেশি, তার অন্যান্য খরচ কম। কিন্তু এপেক্সের উৎপাদন খরচও বেশি, অন্যান্য খরচও বেশি, যেটি তার মুনাফা কমিয়ে দিচ্ছে।
বিবেচনায় নেয়া চার বছরে ফরচুন সুজ প্রতি ১০০ টাকার বিক্রিতে কাঁচামাল আর কারখানা খরচ হিসেবে দেখিয়েছে সর্বোচ্চ ৭৯ টাকা ৪২ পয়সা। তবে তাদের অন্যান্য খরচ সবচেয়ে কম, ৩ টাকা ৬৪ পয়সা। কর দেয়ার আগে মুনাফা ছিল ১৭ টাকা ২৭ পয়সা, আর কর দেয়ার পরে ১৫ টাকা ৫০ পয়সা।
লিগ্যাসি ফুটওয়্যার চার বছরে প্রতি ১০০ টাকার বিক্রিতে কাঁচামাল আর কারখানা খরচ দেখিয়েছে ৬৬ টাকা ৯৯ পয়সা। অন্যান্য খরচ ১৯ টাকা ৪৬ পয়সা। কর দেয়ার আগে মুনাফা ছিল ১৩ টাকা ৫৫ পয়সা। কর-পরবর্তী মুনাফা ১১ টাকা ৯৬ পয়সা।
বাটা প্রতি ১০০ টাকার বিক্রিতে কাঁচামাল আর কারখানা খরচ হিসেবে দেখিয়েছে ৫৭ টাকা ৩০ পয়সা। অন্যান্য খরচ ৩১ টাকা ৭১ পয়সা। কর দেয়ার আগে মুনাফা ছিল ১১ টাকার মতো। আর কর দেয়ার পরে মুনাফা হয়েছে ৭ টাকা ৩৬ পয়সা।
এপেক্স ফুটওয়্যার এই চার বছরে প্রতি এক শ টাকার বিক্রিতে কাঁচামাল আর কারখানা খরচ হিসেবে দেখিয়েছে ৭৭ টাকা ৩৪ পয়সা। অন্যান্য খরচ ২১ টাকা ৭ পয়সা। কর দেয়ার আগে মুনাফা ছিল মাত্র ১ টাকা ৫৯ পয়সা। আর কর দেয়ার পরে মুনাফা ৭৬ পয়সা।
রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তা কোথায় যাচ্ছে
বিবেচনায় নেয়া চার বছরে এপেক্স ফুটওয়্যার বিদেশে জুতা রপ্তানি করেছে ৩ হাজার ২৮ কোটি টাকা।
রপ্তানির বিপরীতে নগদ প্রণোদনা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ যে আদেশ, তাতে দেখা যাচ্ছে, চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা থাকছে ১৫ শতাংশ।
এপেক্সের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা দিলীপ কাজুরি নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন, তারা এই হারেই নগদ প্রণোদনা পাচ্ছেন, তবে এখানে ১০ শতাংশ উৎসে কর কাটা হয়।
অর্থাৎ প্রকৃত প্রণোদনা মেলে সাড়ে ১৩ শতাংশ। এই হিসাবে এই ৩০২৮ কোটি টাকার বিপরীতে কেবল নগদ প্রণোদনাই পাওয়ার কথা ৪০৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
জুতা চামড়ার না হয়ে সিনথেটিক ও ফেব্রিক্সের মিশ্রণ হলেও একই হারে প্রণোদনা মেলে।
অথচ বিবেচনায় নেয়া চার বছর মিলিয়ে এপেক্স তাদের চূড়ান্ত আয় ৬০ কোটি টাকা দেখায়নি।
ঋণের বিপরীতে সুদকে অজুহাত
বাটার কোম্পানি সচিব হাশিম রেজা বলেন, ‘আমি দেখেছি তাদের অনেক ঋণ আছে। তাদের অনেক সুদ দিতে হয়। এই কারণে হয়তো তাদের মুনাফার হার কম।’
২০২১ সালের হিসাবে দেখা যায়, এপেক্সের মোট ঋণ ১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। আর ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ আর ২০২১ সাল- এই চার বছরে তারা সুদ দিয়েছে ২৬৪ কোটি টাকা।
কিন্তু এর চেয়ে বেশি তারা পেয়েছে রপ্তানি প্রণোদনা। আর পণ্য রপ্তানি থেকে মুনাফাও আছে।
এই যে রপ্তানি আয়, সেটি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখও করা হয় না। ফলে বিনিয়োগকারীরা এই বিষয়টি নিয়ে আসলে কিছুই জানেন না।
এই সন্দেহজনক হিসাবের বিষয়টি নিয়ে এপেক্সের বক্তব্য জানতে চাইলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুরকে কয়েকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি।
পরে কোম্পানি সচিব ওমর ফারুককে প্রশ্ন করলে তিনি কিছু বলতে চাননি। বলেন, ‘এ বিষয়টি আমি জানি না। এই বিষয়টি নিয়ে ভালো কথা বলতে পারবেন আমাদের ফাইন্যান্স বিভাগের কর্মকর্তারা।’
তার পরামর্শেই কোম্পানির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান অর্থ কর্মকর্তা দিলীপ কাজুরির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে। প্রতিবছর আমাদের অনেক টাকা সুদ দিতে হয়। এই কারণে আমাদের খরচ অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। বলেতে পারেন আমরা নিজের জন্য ব্যবসা করি না। ব্যাংকের জন্য ব্যবসা করি।’
যে পরিমাণ ঋণ ও তার বিপরীতে সুদ, তার চেয়ে রপ্তানির নগদ প্রণোদনা যে অনেক বেশি, সেই বিষয়ে প্রশ্ন রাখলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ক্রেতারা আমাদের দেশে আসতে চায় না। এ জন্য আমাদের দেশের বাইরের এজন্টকে ১০০ টাকা বিক্রি হলে ৬ টাকা কমিশন দিয়ে দিতে হয়। মাঝে মাঝে পণ্য রিজেক্ট হলে অনেক টাকা ক্ষতি হয়। আবার কখনও উড়োজাহাজ পণ্য পাঠাতে হয়। সব মিলিয়ে খরচ বেশি পড়ে।’
রপ্তানির বিপরীতে যে প্রণোদনা, সেটি কেন আর্থিক বিবরণীতে উল্লেখ করেন না, জানতে চাইলে দিলীপ কাজুরি বলেন, ‘আয়ের সঙ্গে রিপোর্ট করা হয় বলে আর্থিক প্রতিবেদনে অলাদাভাবে দেখানো যায় না।’
তার দাবি, এটি করতে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা আছে।
বিপুল রিজার্ভের কী কাজ
আবার পুঁজিবাজারে দেয়া হিসাব অনুযায়ী এপেক্সের রিজার্ভের পরিমাণ ২৭০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
যদি এই টাকা কাজে না লাগিয়ে কেবল ব্যাংকে সঞ্চয়ী হিসেবেও রাখা হয় এবং যদি শতকরা ৬ শতাংশ হারেও সুদ পাওয়া যায়, তাহলেও বছরে ১৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা সুদ পাওয়া যায়। যদি করপোরেট কর হিসেবে সাড়ে ২২ শতাংশ কেটেও নেয়া হয়, তারপরেও পাওয়ার কথা ১২ কেটি ৫৯ লাখ ১২ হাজার টাকা, যা কোম্পানিটির দেখানো চূড়ান্ত মুনাফার চেয়ে বেশি হতো।
স্বতন্ত্র পরিচালক ফরাসউদ্দিন যা বললেন
পুরো বিষয়টি জানানো হলে এপেক্স ফুটওয়্যারের স্বতন্ত্র পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন নিউজবাংলাকে জানান, এসবের কিছুই তার জানা নেই। তিনি বলেন, ‘আমাকে বিষয়টি দেখতে দিন। যদি কোনো সমস্যা পাই আমি তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসব।’