দরপতন ঠেকাতে সব শেয়ারের বেঁধে দেয়া সর্বনিম্ন দর বা ফ্লোর প্রাইসও এখন সূচক পড়ে যাওয়া ঠেকাতে পারছে না। দুই সপ্তাহ আগে ফ্লোর ভেঙে শেয়ারগুলোর বের হয়ে আসার চেষ্টা শুরু হতে না হতেই থেমে গেছে। ফ্লোরের বেশি দর আছে, এমন কোম্পানিগুলোর সিংহভাগই এখন দর হারাচ্ছে, ফলে সূচক পড়ছেই।
রোববার নতুন সপ্তাহ শুরু হলো বেশ বড় দরপতনের মধ্য দিয়ে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে আড়াই শরও বেশি কোম্পানির শেয়ারের দাম কমতে পারছে না, এই অবস্থাতেও সূচক পড়ে গেছে ৪৮ পয়েন্ট। সূচকের বর্তমান অবস্থান গত পৌনে তিন মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
গত ৩১ জুলাই থেকে ফ্লোর প্রাইসে উত্থান শুরুর পর ২২ আগস্ট সূচক পৌঁছে ৬ হাজার ৩০০ পয়েন্ট। এরপর তা আরও টানা বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে ৬ হাজার ৬০০ পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায় সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে। এরপর থেকে শুরু হয় টানা পতন।
এই সূচকের উত্থান ভারসাম্যপূর্ণ ছিল না। গোটা চল্লিশেক কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির ওপর ভর করে এই উত্থান টেকার কারণ ছিল না। কারণ, যেভাবে দর বেড়েছিল, কিছু কোম্পানি তার চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে দর হারিয়েছে।
এর মধ্যে আবার বিশ্বজুড়ে দুর্ভিক্ষের আলোচনা, রিজার্ভ পতনের মধ্যে আইএমএফের ঋণের নানা শর্তসহ দেখা দেয় নানা ইস্যু। এ নিয়ে গত দুই মাস ধরেই বাজারে চলছে অনিশ্চয়তা।
রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের চিত্র
বিপুলসংখ্যক কোম্পানির শেয়ারের ক্রেতা না থাকার কারণে লেনদেনও কমছে। রোববার যা নেমেছে সাত শ কোটির ঘরে, যা গত ১২ কর্মদিবসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
দিনটি শুরু হয়েছিল ২০ পয়েন্ট বেড়ে। কিন্তু প্রধানত ওষুধ ও রসায়ন খাতের বেশ কিছু কোম্পানির বড় দরপতনে সূচক কমতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত থাকে।
শেষ পর্যন্ত ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স এর অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৩০৪ পয়েন্টে। এর চেয়ে কম সূচক ছিল ৫৭ কর্মদিবস আগে গত ২২ আগস্ট ৬ হাজার ৩০০ পয়েন্টে।
এদিন দর বাড়ে কেবল ২৫টি কোম্পানির, দর হারায় ৮৭টি। আর আগের দিনের দরে হাতবদল হয়েছে ২৩২টি কোম্পানির শেয়ার, যেগুলো মূলত ফ্লোর প্রাইসে লেনদেন হচ্ছে। ৪৫টি কোম্পানির একটি শেয়ারও লেনদেন হয়নি।
দিন শেষে হাতবদল হয়েছে ৭২৪ কোটি ১৫ লাখ ৬৪ হাজার টাকার শেয়ার। এর চেয়ে কম লেনদেন হয়েছিল ১২ কর্মদিবস আগে ২৬ অক্টোবর, ৭৪১ কোটি ৮০ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।
এই লেনদেনও আবার ভারসাম্যপূর্ণ নয়। মোট লেনদেনের ৪৬.৫৫ শতাংশ হয়েছে কেবল ১০টি কোম্পানিতে। এই ১০ কোম্পানিতে হাতবদল হয়েছে ৩৩৭ কোটি ১২ লাখ ৭১ হাজার টাকা।
অন্যদিকে ফ্লোর প্রাইসে থাকা ২৩২টি কোম্পানিতে হাতবদল হয়েছে কেবল ২৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর সাড়ে তিন গুণ লেনদেন হয়েছে শীর্ষে থাকা জেনেক্স ইনফোসিসে। এই কোম্পানিটির ৮৫ কোটি ৩৭ লাখ ২৪ হাজার টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
পতনের হার ব্যাপক
এদিন অনেকগুলো কোম্পানি কেবল দর হারায়নি, দরপতনের হারও ছিল ব্যাপক। তবে সবচেয়ে বেশি পতন হওয়ার তালিকার শীর্ষে দেখালেও দুটি কোম্পানির মধ্যে একটির দর আসলে বেড়েছে। সেটি হলো জেমিনি সি ফুড। ৩০ শতাংশ বোনাস শেয়ার ঘোষণার কারণে মূল্য সমন্বয়ের পর আসলে এর শেয়ারদর বেড়েছে।
এই তালিকার দ্বিতীয় স্থানে থাকা বিডি ল্যাম্পসের দরও অতটা কমেনি। ১০ শতাংশের বেশি দরপতন হলেও কোম্পানিটি ৭ শতাংশ বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছে।
ওষুধ খাতের কোম্পানি রেনাটা ছয় শতাংশের বেশি দর হারিয়েছে দেখালেও আসলে ৭ শতাংশ বোনাস শেয়ার সমন্বয় হয়েছে।
তবে চারটি কোম্পানির ৯ শতাংশের বেশি, তিনটি কোম্পানির ৮ শতাংশের বেশি, চারটি কোম্পানির ৭ শতাংশের বেশি, দুটি কোম্পানির ৬ শতাংশের বেশি, ৮ কোম্পানির ৫ শতাংশের বেশি, ৬টি কোম্পানির ৪ শতাংশের বেশি, ৭টি কোম্পানির ৩ শতাংশের বেশি ও ১২টি কোম্পানির ২ শতাংশের বেশি দরপতন হয়েছে।
বিপরীতে ৩টি কোম্পানির ৯ শতাংশের বেশি, একটি করে কোম্পানির ৭, ৬ ও ৫ শতাংশ, তিনটি করে কোম্পানির ৪ ও ৩ শতাংশ ও দুটি কোম্পানির ২ শতাংশ করে দর বেড়েছে।
‘অর্থনীতির অনিশ্চয়তা পুঁজিবাজারে’
পুঁজিবাজারের মন্দার কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেন ট্রেজার সিকিউরিটিজের শীর্ষ কর্মকর্তা মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সরকার জ্বালানি শক্তি ব্যবহার কমানোর চেষ্টা করছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। এতে প্রথম প্রান্তিকে আয় কমবে। যা ইতোমধ্যে আসতে শুরু করেছে।’
তিনি বলেন, ‘রিজার্ভ ও অন্যান্য সূচকের প্রকৃত চিত্র নিয়ে যে আলোচনা চলছে, তা নিয়ে একটা অস্থিরতা রয়েছে। এমনকি নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও নয়, মানুষ চাইছে হাতে টাকা থাকুক। পুঁজিবাজার তো দূরের কথা অন্য কোনো বিকল্প ভাবছেন না তারা।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এলসি খুলছে না ব্যাংকগুলো। এমনকি খাদ্যপণ্যের জন্যও না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, এলসির জন্য তারা ডলার সহায়তা করবে না। নিজেদের রিজার্ভ দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে ডলার সংগ্রহ করে ব্যাংকগুলো চাইলে করতে পারে।
‘এমনিতেই রেমিট্যান্স কমে গেছে আমরা খবরে দেখছিই। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি সহায়তা না করে তাহলে ব্যাংকগুলো কোথায় থেকে ব্যবস্থা করবে, এটা একটা প্রশ্ন।’
মোস্তফা বলেন, ‘তবে মার্কেট অনেক দিন থেকেই নেতিবাচক প্রবণতায় ছিল। কারণ কয়েক মাস থেকে নির্দিষ্ট কয়েকটা স্টকের ওপর ভর করে চলছিল। যখন কোনো পরিবার যখন একজন ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়, এবং ওই ব্যক্তির কিছু হলে পরিবার ঝুঁকিতে পড়ে, তেমনটাই হয়েছে পুঁজিবাজারে।’
সূচকে প্রভাব যাদের
সবচেয়ে বেশি ১২ দশমিক ৭৫ পয়েন্ট সূচক কমেছে রেনাটার দরপতনে। কোম্পানিটির দর কমেছে ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। তবে এই কোম্পানিটির শেয়ারদরে আসলে ৭ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়ার ঘোষণার কারণে সমন্বয় হয়েছে।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ৮৬ পয়েন্ট কমেছে বিকন ফার্মার কারণে। শেয়ার প্রতি দাম কমেছে ৫ দশমিক ০৭ শতাংশ।
বেক্সিমকো ফার্মার দর ৩ দশমিক ০৪ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে ২ দশমিক ৯২ পয়েন্ট।
এ ছাড়া লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ, ওরিয়ন ফার্মা, বসুন্ধরা পেপার, সোনালী পেপার, ইউনিক হোটেল, জেএমআই হসপিটাল ও কোহিনূর কেমিক্যালের দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ৩৬ দশমিক ৩৫ পয়েন্ট।
বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ১ দশমিক ৩৭ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে ওরিয়ন ইনফিউশন। এদিন শেয়ারটির দর বেড়েছে ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ।
সি-পার্লের দর ৪ দশমিক ০২ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে ১ দশমিক ১৮ পয়েন্ট।
আর কোনো কোম্পানি সূচকে ১ পয়েন্ট যোগ করতে পারেনি।
মেঘনা পেট্রোলিয়াম সূচকে যোগ করেছে শূন্য দশমিক ৫৪ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে ১ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
এর বাইরে সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে এডিএন টেলিকম, আমরা নেটওয়ার্কস, বিডি থাই ফুড, আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, মনোস্পুল, বিডি ওয়েল্ডিং ও ন্যাশনাল টি।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ৫ দশমিক ১০ পয়েন্ট।
শীর্ষ ৫ খাত যেমন
আগের দিনের মতোই শীর্ষ রয়েছে প্রযুক্তি খাত। লেনদেন হয়েছে ১৫৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা আগের দিনে ছিল ১৫০ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
৫টি করে কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে ৪টির দরপতন হয়েছে। ২টি কোম্পানির লেনদেন হয়েছে আগের দরে।
১৪৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা থেকে কমে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ওষুধ ও রসায়ন খাতে হাতবদল হয়েছে ১১৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা। বুধবার লেনদেন ছিল ১৭১ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
একটি কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে ১৯টির লেনদেন হয়েছে অপরিবর্তিত দরে, ৯টির দরপতনে।
তৃতীয় স্থান ধরে রেখেছে সেবা ও আবাসন খাত। লেনদেন হয়েছে ৬৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যা আগের কর্মদিবসে ছিল ৬৯ কোটি টাকা।
খাতের একটি কোম্পানির লেনদেন হয়েছে অপরিবর্তিত দরে ও তিনটির দরপতনে।
৬৪ কোটি ২০ লাখ টাকা লেনদেন করে চতুর্থ স্থানে থাকা বিবিধ খাতের ৮টি কোম্পানির লেনদেন হয়েছে আগের দরে আর ৫টির দরপতনে।
পরের স্থানে থাকা কাগজ ও মুদ্রণ খাতে হাতবদল হয়েছে ৫৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা বৃহস্পতিবার ছিল ৬৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
দুটি করে কোম্পানির দরবৃদ্ধি, দরপতন ও অপরিবর্তিত দরে লেনদেন হয়েছে।
বাকি খাতের লেনদেন ছিল ৫০ কোটির নিচে।
দরবৃদ্ধির শীর্ষ ১০
সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ দর বেড়ে চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২৮ টাকা ১০ পয়সায়। আগের দিনে লেনদেন হয় ২৫ টাকা ২৬ পয়সায়।
৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেড়ে বিডি ওয়েল্ডিং শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৩২ টাকা ৯০ পয়সায়, যা আগের দিন ছিল ৩০ টাকায়।
তালিকার তৃতীয় স্থানে ছিল আমরা নেটওয়ার্কস। ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ দর বেড়ে শেয়ারটি হাতবদল হয়েছে ৫৩ টাকা ৬০ পয়সায়। আগের দিনের দর ছিল ৪৮ টাকা ৯০ পয়সা।
এ ছাড়া দরবৃদ্ধির দশে ছিল- মুন্নু অ্যাগ্রো, বিডি থাইফুড, ওরিয়ন ইনফিউশন, মনোস্পুল, বেঙ্গল উইন্ডসর, সি-পার্ল ও এডিএন টেলিকম।
দরপতনের শীর্ষ ১০
সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ কমেছে জেএমআই হসপিটালের শেয়ার দর। প্রতিটি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৯০ টাকা ৭০ পয়সায়, যা আগের দিনে ছিল ১০০ টাকা ৭০ পয়সায়।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ কমে বসুন্ধরা পেপারের দর নেমেছে ১০৬ টাকা ৫০ পয়সায়। আগের দিনের দর ছিল ১১৭ টাকা ৯০ পয়সা।
৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ দর কমে নাভানা ফার্মার শেয়ার বেচাকেনা হয়েছে ১০৬ টাকা ৩০ পয়সায়। আগের দিনের দর ছিল ১১৭ টাকা ৪০ পয়সায়।
এ ছাড়াও পতনের তালিকায় শীর্ষ দশের মধ্যে ছিল- সিনোবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজ, লুবরেফ বাংলাদেশ, কোহিনূর কেমিক্যাল, ইস্টার্ন হাউজিং, দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, আইটি কনসালট্যান্টস ও সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্স।