অর্থ পাচার ও কালোটাকা না কমলে বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়বে না। এ জন্য ডিজিটাল ফাইন্যান্সের ক্ষেত্রে উন্নতি করতে হবে। কেন আমেরিকা থেকে বৈধ পথে বেশি রেমিট্যান্স আসছে, আর কেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে কম আসছে, এসব বিষয় চিহ্নিত করতে হবে।
বুধবার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত সেমিনারে এমন অভিমত তুলে ধরেন বক্তারা।
তারা বলেন, বৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে প্রবাসীদের জন্য প্রক্রিয়াটি সহজ করার পাশাপাশি সুবিধাভোগীর কাছেও তা নিরাপদে ও তাৎক্ষণিকভাবে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মই হতে পারে সবচেয়ে ভালো মাধ্যম।
রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে 'বৈধ পথে সহজে নিরাপদে ডিজিটাল মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে করণীয়’ শীর্ষক এই সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
ইআরএফ সভাপতি শারমীন রিনভীর সভাপতিত্বে বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম। এতে অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও বিশেষজ্ঞরা নানা সুপারিশ তুলে ধরেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘অনেক শ্রমিক নিজের প্রয়োজনে বাইরে গেছে। আমরা প্রবাসীদের কাছ থেকে কৌশলে রেমিট্যান্স আনার চেষ্টা করছি। প্রবাসীরা না খেয়ে আবেগে টাকা পাঠান মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানদের জন্য।
‘আগে দেখতাম প্রবাসীদের টাকা ব্যাগে করে দিয়ে যেতেন অপরিচিত কিছু লোক। তারা প্রবাসীর পরিবারের কাছে এসে খাওয়া-দাওয়া শেষে টাকার প্যাকেট দিয়ে যেতেন। প্রথমে আমরা বুঝিনি। এখন বুঝছি তারা হুন্ডিওয়ালা।
‘গ্রামের অনেকে ব্যাংকে যেতে চায় না। কাচের ঘরের প্রতিষ্ঠান, টাই পরা মানুষ কাজ করছে, এদের কাছে গ্রামের মানুষ যেতে চায় না। এখানে একটা গ্যাপ থেকেই গেছে৷’
মন্ত্রী মান্নান বলেন, ‘বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনতে যারা কাজ করছে তাদের সঙ্গে প্রবাসীদের দূরত্ব কমাতে না পারলে রেমিট্যান্স বাড়ানো যাবে না। এ জন্য সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ডিজিটাল মাধ্যম কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।’
‘মধ্যপ্রাচ্যে যারা লোক পাঠান তাদের অনেকেরই অক্ষরজ্ঞান নেই। একটু প্রশিক্ষণ পেলে তারা দক্ষ হিসেবে কাজ করতে পারেন। আমাদের যে লোকটা উটের সামনে হাঁটেন, অন্য দেশে গেলে তিনি অনেক টাকা পাবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বের সঙ্গে আমাদের ক্যালেন্ডারের মিল নেই। শুক্র ও শনিবার আমাদের সাপ্তাহিক বন্ধ। রোববার বাইরে বন্ধ। এভাবে তিন দিন এক প্রকার বন্ধই থাকে৷ আরবের অনেক দেশে এখন শুক্রবারেও কাজ চলে। এ কারণে হুন্ডিতে লেনদেনের পথ বেছে নিচ্ছেন অনেকেই। সরকার এসব প্রথা ভেঙে একটা প্রবণতা চালু করতে চায়। এ জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে।’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বর্তমান সংকটে আমরা প্রতিমাসে ১ দশমিক ২/৩ বিলিয়ন রিজার্ভ হারাচ্ছি। এজন্য রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে।
‘আমদানি কমানো পারমানেন্ট সমাধান নয়। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। দেশে থেকে কেউ যদি ডলার আয় করে সেটাও রেমিট্যান্স। বাইরে থাকতেই হবে এমন নয়। দেশের বাইরে যারা থাকে তারা যেন ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠায় সেভাবে তাদের মোটিভেশন দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি মানুষ মধ্যপ্রাচ্যে থাকলেও ডিজিটালি উন্নত বলে উত্তর আমেরিকা থেকে রেমিট্যান্স আসে বেশি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে কম আসছে। ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের ব্যবধান কমাতে হবে৷ ১০৭ ও ১১৬- এ ব্যবধান না কমালে হবে না। বৈধ ও অবৈধ পথে ডলারের হারের পার্থক্য বেশি হলে প্রবাসী শ্রমিকরা হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহী হন।’
কালোটাকার বাজার কমিয়ে আনতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। না হলে দীর্ঘমেয়াদি সুফল মিলবে না।’
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের চেয়ারম্যান ড. বজলুল এইচ খন্দকার। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ছে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ানো এবং আমদানি কমানোর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো যাবে।
‘২০১৯ ও ২০২০ সালে দেশে রেমিট্যান্স আসা অনেক বেড়েছিল। ওই সময়ে সরকার প্রণোদনা চালু এবং ডিজিটাল লেনদেন বাড়ানোসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল। বর্তমানে রেমিট্যান্স আনতে বৈশ্বিকভাবে গড়ে ৬ শতাংশের বেশি খরচ হচ্ছে। এটা কমিয়ে আনতে হবে। হুন্ডির মাধ্যমে দ্রুত ও অনেক কম খরচে টাকা পাঠানোর সুবিধার কারণেই ওই পথ বেছে নিচ্ছেন প্রবাসীরা। এখানে অবৈধভাবে টাকা পাচার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং বাড়লেও এখনও বৈশ্বিকভাবে আমরা পিছিয়ে আছি। বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনতে এমএফএসসহ ডিজিটাল মাধ্যমের ব্যবস্থা করতে পারলে খরচ ও সময় অর্ধেক কমানো সম্ভব। এক্ষেত্রে রেমিট্যান্স আসার পরেই তা ক্যাশ আউট হয়ে গেলে কিন্তু সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়া যাবে না। বরং ইকোসিস্টেম শক্তিশালী করে ডিজিটাল মাধ্যমেই তা ব্যবহার করলে দেশের অর্থনীতি আরও বেশি শক্তিশালী হবে। এজন্য দেশেও ডিজিটাল ফাইন্যান্স সেবা বাড়াতে হবে।
প্রবাসীদের সংজ্ঞা পরিবর্তনের কথা বলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শরমিন্দ নিলোর্মি। তিনি বলেন, ‘৬ মাস বাইরে থাকলেই প্রবাসী বলা হয়। এটা পরিবর্তন করা দরকার। দেশে থেকে ডলার আয় করলেও সেটা রেমিট্যান্স হিসেবে ধরা উচিত।
‘শ্রমিকরা বিদেশে কষ্ট করে টাকা পাঠায় অথচ দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। পাঁচ লাখ টাকার ওপর রেমিট্যান্সে সরকার প্রণোদনা দেয়। এই পরিমাণ আরও কমানো যেতে পারে। ওয়েজ আনার্স বন্ডের ক্যাপ তুলে দেয়াও জরুরি।’
তিনি বলেন, ‘দেশের বাইরে কত শ্রমিক আছে সেটা ডিজিটালইজড করা দরকার। বৈধপথে কতজন যাচ্ছেন, দূতাবাসের তালিকায় কতজন আছেন, কতজন নেই- এগুলোর হিসাব করা দরকার।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও বিএফআইইউর সাবেক উপ-প্রধান ইস্কান্দার মিয়া বলেন, ‘অবৈধভাবে যে শ্রমিকরা বিদেশে গেছেন তাদের টাকা কিভাবে বৈধ পথে আনা যায় তার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে এমএফএস এজেন্টদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। টাকা পাচারের পথ বন্ধ করতেও উদ্যোগ নেয়া জরুরি।
‘বিদেশে যারা থাকে তাদের কিন্তু কেউ দেখে না। অন্যান্য দেশের দূতাবাস থেকে তাদের শ্রমিকদের খোঁজ নেয়া হলেও আমাদের দেশের শ্রমিকদের কেউ খবর নেয় না। যেসব দেশে দূতাবাস নেই সেখান থেকে প্রবাসীরা কিভাবে দেশে টাকা পাঠাবে সেটারও খোঁজ রাখা উচিত। তারা যেন কোনো চক্রে না পড়ে সেটা দেখতে হবে।’
বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ও পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো জরুরি। ব্যালান্স অফ পেমেন্ট ঠিক রাখতে হলে ডলার সরবরাহ বাড়াতে হবে। সেবা ও পণ্যদ্রব্য রপ্তানি বাড়াতে হবে। সেবা খাতে রপ্তানি মাত্র ১৪ শতাংশ। দুবাই থেকে রেমিট্যান্স কমেছে কেন সেটা খুঁজে বের করতে হবে। আবার সেই দুবাইয়ে আবাসন খাতে আমাদের বিনিয়োগ বেড়েছে, এটাও দেখতে হবে।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশে ডিজিটাল ফাইন্যান্সিং শুরু হয়েছে অনেক পরে। ভারত ও শ্রীলঙ্কার পর এটা শুরু হলেও আমরা ভালো করছি। কিন্তু তিনটি জায়গায় উন্নয়ন করতে হবে। অবকাঠামোতে ব্যাপক উন্নয়ন দরকার৷ এখনও গ্রামীণ ৪৪ শতাংশ মানুষ ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সেবা ব্যবহার করে না। নারীরাও পিছিয়ে আছে। ৩২ শতাংশ মানুষ নিরাপত্তার কারণে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যবহার করে না। এসব চিহ্নিত করে সমাধান বের করা জরুরি।’
বিকাশের চিফ এক্সটার্নাল অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মেজর জেনারেল (অব.) শেখ মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এই মুহূর্তে বিশ্বের ৭০টি দেশ থেকে ৭৫টি মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১২টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে সেটেলমেন্ট হয়ে বিকাশ অ্যাকাউন্টে রেমিট্যান্স আসছে। ২০২১ সালে বিকাশে ২৪২৭ কোটি টাকার সমপরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। এই বছর শেষে তা চার হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘এক কোটি ৩০ লাখ প্রবাসী দেশের বাইরে থাকে। তাদের মধ্যে ৭৫ লাখই আছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। অথচ ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সেবার মাধ্যমে রেমিট্যান্স পশ্চিমা দেশ থেকে বেশি আসে।’
বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুল মওলা বলেন, প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে সমস্যা দূর করতে পারলে রিজার্ভের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা মোকাবেলা করা সহজ হবে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স আনা গেলে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি আগামী দুই তিন মাসের মধ্যে মেটানো সম্ভব হবে।
‘ইসলামী ব্যাংকে পুরো রেমিট্যান্স সিস্টেম অটোমেশন করা হয়েছে। এজন্য টাকা জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা গ্রাহক জানতে পারছে।
‘করোনার সময় শুধু ব্যাংক খোলা ছিল। এজন্য বৈধপথে তখন রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে সবাই। কিন্তু করোনার পর রেমিট্যান্স কমে গেছে। কারণ অন্যান্যভাবে অনেকে টাকা পাঠাচ্ছে। এজন্য ব্যাংকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে।
উন্নয়ন সমুন্নয়-এর এমিরেটস ফেলো খন্দকার সাখাওয়াত আলী বলেন, ‘প্রবাসীদের আয় করা ডলার একটি গ্রুপ রেখে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে উৎস পর্যায়ে হুন্ডির সমাধান করতে হবে। পাশাপাশি সরাসরি প্রবাসীদের এমএফএসে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুবিধা চালু করা সম্ভব হলে বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়ানো সম্ভব হবে।’