বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমে ৩ হাজার ৪০০ কোটি (৩৪ বিলিয়ন) ডলারের ঘরে নেমে এসেছে।
সোমবার রিজার্ভ থেকে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১৩৫ কোটি (১.৩৫ বিলিয়ন) ডলার আমদানি বিল পরিশোধ করা হয়। একইসঙ্গে আমদানি দায় মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে ১৩ কোটি ১০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়। ফলে দিন শেষে রিজার্ভ কমে ৩ হাজার ৪৩০ কোটি (৩৪.৩০ বিলিয়ন) ডলারে দাঁড়িয়েছে।
সোমবার দিনের শুরুতে রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৫৭৭ কোটি (৩৫.৭৭ বিলিয়ন) ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রিজার্ভ থেকে আকু বিল পরিশোধ করা হয়েছে। আমদানি দায় মেটাতেও রিজার্ভ থেকে কিছু ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর ফলে রিজার্ভ কমে কত হলো, তার প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে আগামীকাল মঙ্গলবার।’
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমায় রিজার্ভ কমেছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
সেপ্টেম্বরের মতো সদ্য শেষ হওয়া অক্টোবর মাসেও রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কমেছে। এ মাসে ১৫২ কোটি ৫৪ লাখ (১.৫২ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত আট মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।
গত বছরের অক্টোবরে ১৬৪ কোটি ৬৯ লাখ (১.৬৪ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল। আগের মাস সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৫৪ কোটি ডলার। এ হিসাবে গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে এই অক্টোবরে ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ রেমিট্যান্স কম এসেছে। আর সেপ্টেম্বরের চেয়ে কম এসেছে ১ শতাংশের মতো।
গত ফেব্রুয়ারিতে ১৪৯ কোটি ৪৪ লাখ (১.৪৯ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। এর পর আট মাস পর সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স এসেছে অক্টোবরে।
অন্যদিকে অক্টোবর মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪৩৫ কোটি ৬৬ লাখ (৪.৩৫ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয় কম প্রায় ১৩ শতাংশ।
১৩ মাস পর গত সেপ্টেম্বরে ঋণাত্মক (নেগেটিভ) প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। ওই মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার আয় করেন রপ্তানিকারকরা, যা ছিল গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ কম। সেই ধারাবাহিকতায় অক্টোবরেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই চার মাসে লক্ষ্যের চেয়ে রপ্তানি কমেছে শূন্য দশমিক ৭৪ শতাংশ। তবে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় বেড়েছে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
গত বছরের আগস্টে এই রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। এক বছর আগে ৫ নভেম্বর রিজার্ভ ছিল ৪৬ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার।
আড়াই বছরের করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে দেশের অর্থনীতি নিয়ে নানা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছিল। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর থেকে রিজার্ভের প্রধান এই দুই সূচকেও দুঃসংবাদ এসেছে।
আর এই দুই সূচকে নেতিবাচক ধারার কারণে বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে সবচেয়ে স্পর্শকাতর সূচক রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
আইএমএফের হিসাবে ২৬.৩ বিলিয়ন ডলার
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব নিয়ে প্রশ্ন আছে। বেশ কিছুদিন ধরেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের যে তথ্য প্রকাশ করছে, তা থেকে প্রকৃত রিজার্ভ ৮ বিলিয়ন ডলার কম।
সংকট মোকবিলায় সরকার আইএমএফের কাছে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের যে ঋণ চেয়েছে, তা নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনার জন্য আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল এখন ঢাকায়। ইতোমধ্যে গভর্নরসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও করছেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। বৈঠকে রিজার্ভের হিসাবায়নে মোট রিজার্ভ ও প্রকৃত রিজার্ভকে নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করার কথা বলা হয়। রিজার্ভ থেকে কোন কোন বিনিয়োগকে বাদ দিয়ে প্রকৃত রিজার্ভ হিসাব করতে হবে, তা-ও আবার স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে সম্মতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব নিয়ে। আইএমএফ বলছে, ভুল শ্রেণিকরণের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের আকার বড় হয়েছে বলে দাবি করে আইএমএফ।
২০২১ সালে আইএমএফ বলেছিল, চলতি বছরের জুনের শেষ দিকে বাংলাদেশে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ থাকার যে কথা বলা হয়েছিল, তা আসলে ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে বলা হয়েছে। রিজার্ভবহির্ভূত সম্পদ অন্তর্ভুক্ত করে রিজার্ভ ৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এবার ঋণ নিয়ে আলোচনা করতে এসে আইএমএফ কর্মকর্তারা বেশ জোরালোভাবেই এ বিষয়টি তুলে ধরে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে এক ধরনের শর্ত হিসেবেই যুক্ত করে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এতে সম্মত হয়েছে বলে জানা গেছে। ফলে এখন থেকে আইএমএফের কাছে তথ্য পাঠানোর সময় প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য পাঠানো হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ৭ বিলিয়ন দিয়ে গঠন করেছে রপ্তানিকারকদের জন্য রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ)। আবার রিজার্ভের অর্থ দিয়ে গঠন করা হয়েছে লং টার্ম ফান্ড (এলটিএফ) ও গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ)। বাংলাদেশ বিমানকে উড়োজাহাজ কিনতে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে রিজার্ভ থেকে ঋণ দেয়া হয়েছে। আবার পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতেও রিজার্ভ থেকে অর্থ দেয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কাকে ২০ কোটি ডলার ঋণ দেয়া হয়েছে। এসব খাতে সব মিলিয়ে ব্যবহৃত হয়েছে ৮ বিলিয়ন ডলার।
আইএমএফ বলছে, এসব বিনিয়োগকে বাদ দিয়ে রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব করতে হবে। কারণ রিজার্ভের এসব অর্থ চাইলেই ফেরত পাওয়া যাবে না। জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে না।
আইএমএফের এই হিসাবে বাংলাদেশেল রিজার্ভ এখন ২৬ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। সেপ্টেম্বরে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। সেই হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে পৌণে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
আর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ৩৪ দশামিক ৩০ বিলিয়ন ডলার ধরলে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে প্রায় পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি দেশের কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ রিজার্ভ থাকতে হয়। সে বিবেচনায় বেশ অস্বস্তিতে আছে বাংলাদেশ সরকার।
তবে আশার কথা, ডিসেম্বরের মধ্যে আইএমএফের ঋণের সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রথম কিস্তির দেড় বিলিয়ন ডলার পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই ঋণ পাওয়া গেলে সংকট কিছুটা হলেও কেটে যাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা আহসান এইচ মনসুর।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আইএমএফের মূল কাজ হচ্ছে ক্রাইসিস ঠেকানো। সংস্থাটির এই ঋণ একটি আস্থার সৃষ্টি করবে। বিশ্বব্যাংক তখন পাশে থাকবে। তারা ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার কম সুদের যে ঋণ দিতে চাচ্ছে, সেটা দ্রুত দিয়ে দেবে।
‘এডিবি এগিয়ে আসবে। জাইকা আসবে। সবাই এগিয়ে আসবে। তখন তারা সবাই তাদের সাপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসবে। রিজার্ভ বাড়বে; সরকার সাহস পাবে। আর সেই সাহসের ওপর ভর করে করোনা মহামারির মতো এই সংকটও মোকাবিলা করতে পারবে।’
এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন-আকু হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি আন্ত-আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তিব্যবস্থা। এর মাধ্যমে এশিয়ার ৯ দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, তা প্রতি দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি হয়। তবে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন তাৎক্ষণিক সম্পন্ন হয়।
আকুর সদস্যদেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভুটান ও মালদ্বীপ। তবে দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় সম্প্রতি এ তালিকা থেকে বাদ পড়েছে শ্রীলঙ্কা।