বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি সম্পর্ক জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সফররত প্রতিনিধি দল। এ ছাড়া পাইপলাইনে আটকে থাকা ঋণ দ্রুত ছাড়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কেও জানতে চেয়েছে তারা।
ঋণ নিয়ে সরকারের চলমান আলোচনার অংশ হিসেবে সোমবার শেরেবাংলা নগরে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে বৈঠকে এসব তথ্য জানতে চান আইএমএফ কর্মকর্তারা।
আইএমএফ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন সংস্থার এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দ। অপরদিকে, ইআরডির সচিব শরীফা খান বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে নেতৃত্ব দেন।
বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য, বাজেট সহায়তা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের চাওয়া ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে আলোচনা করতে ১০ সদেস্যের আইএমএফের স্টাফ মিশন এখন ঢাকায়। বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, অর্থবিভাগের কর্মকতাসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করার পর তাদের সফর প্রায় শেষের দিকে।
সোমবার ইআরডি ছাড়ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করে আইএমএফ প্রতিনিধি দল।
ঢাকা ছাড়ার আগে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে আইএমএফ কর্মকর্তাদের। ১৫ দিনের বাংলাদেশ সফর শেষে একটি যৌথ বিবৃতি দেয়া হবে। ৯ নভেম্বর ঢাকা ছাড়া করার কথা এই মিশনের।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশি-বিদেশি মিলে সরকারের ঋণের পরিমাণ এখন মোট দেশজ উৎপাদনের বা জিডিপি ৪২ শতাংশের বেশি।
এর মধ্যে বিদেশি ঋণের অংশ ১৭ শতাংশ। বাকি অংশ দেশি ঋণ। ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাব মতে, সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ ১৪৭ বিলিয়ন ডলার । বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৪ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এই ঋণের মধ্যে ৫৮ শতাংশ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া। অবশিষ্ট অংশ বিদেশি ঋণ।
বৈঠকে ইআরডির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ নিয়মিতভাবে ঋণ পরিশোধ করে যাচ্ছে। সরকার যে পরিমাণ ঋণ নিচ্ছে, তা জিডিপির তুলনায় সহনীয়। বাংলাদেশ কখনই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি।
আগামী কয়েক বছরে বাংলাদেশ যে পরিমাণ ঋণ নেবে, তাতে সুদ-আসলসহ ঋণের অঙ্ক আরও বেড়ে যাবে। তখন ঋণ পরিশোধে দায় বাড়বে কিনা, আইএমএফ কর্মকর্তাদের এমন প্রশ্নের জবাবে ইআরডির কর্মকর্তা জানান, ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণও বাড়ছে। ফলে দায় বাড়লেও ঋণ পরিশোধে কোনো সমস্যা হবে না।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের আসল, সুদসহ ২০১ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। পরিসংখ্যানে বলে, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি সংকটে পড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের কঠিন শর্তের ঋণগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের জন্য এখনই বড় বিপদের শঙ্কা নেই। তবে ঋণ ব্যবস্থাপনা ও প্রকল্প বাস্তবায়নে আরও সতর্ক হতে হবে।
সরকারের ঋণ-জিডিপি অনুপাত এখনও বেশি হয়ে যায়নি উল্লেখ করে গবেষণা সংস্থা পিআরআই ও আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, জিডিপির আকার বিবেচনায় নিলে এখনও সরকারের ঋণ নেয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আহরণের হার বাড়ছে না। রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারলে সরকারের ঋণ পরিশোধ ক্ষমতা কমে যাবে। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত অন্তত ২০ শতাংশে উন্নীত করতে না পারলে সংকটের কোনো সমাধান হবে না বলে জানান তিনি।
জানা যায়, আইএমএফ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে পাইপলাইনে আটকে থাকা বিদেশি ঋণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের পাইপলাইনে জমে থাকা ঋণের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা।
বৈঠক সূত্র বলেছে, আটকে থাকা ঋণ দ্রুত ছাড়ের তাগিদ দিয়েছে আইএমএফ। আগামী তিন বছরের বৈদেশিক ঋণ সংগ্রহের লক্ষ্যও জানতে চায় সংস্থাটি।
বর্তমানে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় বেশির ভাগ বড় ও বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প বিদেশি ঋণে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইআরডি সূত্র বলেছে, এসব প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে তাগিদ দিয়েছে আইএমএফ। একই সঙ্গে মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে সমন্বয় বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর দক্ষতা বাড়ানো দরকার বলে মনে করে আইএমএফ। একই সঙ্গে ঋণ চুক্তির ক্ষেত্রে ইআরডির দক্ষতাও বাড়ানোর কথা বলেছে আইএমএফ।
বৈঠক শেষে ইআরডির এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছে। তারা আমাদের কাছে ঋণের বিভিন্ন তথ্য জানতে চেয়েছে। আমরা অবহিত করেছি। নীতিগত কোনো বিষয়ে আলোচনা হয়নি।