নানা পদক্ষেপে আমদানি ব্যয় কমার পরও বৈদেশিক বাণিজ্যে স্বস্তি আসছে না; উল্টো দিন যত যাচ্ছে, অর্থনীতিতে চাপ ততই বাড়ছে। সংকটের আভাসও পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার।
আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১৮ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছর। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই কোনো অর্থবছরে ব্যালান্স অফ পেমেন্টে এত ঘাটতি দেখা যায়নি।
তার আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে এই সূচকে ৪ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি ছিল।
অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টানা গেছে ঠিক। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ইউরোপ-আমেরিকায় পোশাক রপ্তানি কমে যাওয়ায় রপ্তানি আয়ও কমতে শুরু করেছে। একইসঙ্গে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সেও বেশ ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্যালান্স অফ পেমেন্টে ঘাটতি বাড়ছে। মনে হচ্ছে, গত অর্থবছরের মতো এবারও বড় ঘাটতি নিয়েই অর্থবছর শেষ হবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের আগস্ট মাস থেকে আমদানি ব্যয় বাড়তে শুরু করে। পুরো অর্থবছরজুড়েই সেই উল্লম্ফন দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত ৩৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয়েও উল্লম্ফন হয়েছিল; ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। কিন্তু আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছিল ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। সে কারণেই ব্যালান্স অফ পেমেন্টের ঘাটতি চূড়ায় উঠেছিল।
এবার আমদানি ব্যয়ে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আমদানিতে প্রবৃদ্ধির চেয়ে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে। কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরের চেয়ে অনেক কম, ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৫ শতাংশের মতো। গত অর্থবছরে রেমিট্যান্সে এই তিন মাসে ২০ শতাংশের মতো নেগেটিভ (ঋণাত্মক) প্রবৃদ্ধি হলেও এবার ৫ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সব মিলিয়ে ৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের বড় ঘাটতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ।
‘গত অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে পাহাড়সম ঘাটতি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল’ মন্তব্য করে অর্থনীতির বিশ্লেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমদানিতে এখনও যে গতি রয়েছে, সেটা যদি অব্যাহত থাকে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স যেভাবে কমছে, সেভাবে কমলে এবারও ব্যালান্স অফ পেমেন্টে বড় ঘাটতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হবে।’
বেশ কয়েক বছর পর ২০২০-২১ অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ। প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ওই বছর।
তার আগে ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।
বাণিজ্য ঘাটতি ৭.৫ বিলিয়নন ডলার
নানা পদক্ষেপের পরও আমদানি ব্যয় খুব একটা কমছে না। এখনও প্রতি মাসে পণ্য আমদানিতে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। আর এ কারণে পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়েই চলেছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই তিন মাসে বাংলাদেশ রপ্তানির চেয়ে ৭ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য আমদানি করেছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ১৯ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই তিন মাসে ১৭ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।
অন্যদিকে জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ১১ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেশি। গত বছরের এই তিন মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ১০ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল।
এ হিসাবেই অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার।
রেমিট্যান্স বেড়েছে ৪.৯০ শতাংশ
গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম। তবে এবার এই সূচকে উল্লম্ফন নিয়ে অর্থবছর শুরু হয়েছিল। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যা ছিল গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি।
কিন্তু সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই দুই মাসেই দেড় বিলিয়ন ডলার করে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অথচ প্রথম দুই মাসে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি করে পাঠিয়েছিলেন।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
সেবা বাণিজ্যেও ঘাটতি
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১০ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ৬০ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।
সামগ্রিক লেনদেনে ঘাটতি ৩.৪৫ বিলিয়ন ডলার
সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যেও (ওভারঅল ব্যালেন্স) ঘাটতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার।
গত অর্থবছরের একই সময়ে এই সূচকে ৮১ কোটি ডলারের ঘাটতি ছিল। অর্থবছর শেষ হয়েছিল গত ৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে।
তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ওভারঅল ব্যালেন্সে ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।
আর্থিক হিসাবে সামান্য উদ্বৃত্ত
তবে আর্থিক হিসাবে সামান্য উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে আর্থিক হিসাবে (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৩৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে ২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল। ১৩ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। তার আগের অর্থবছরের ১৪ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল।
করোনা মহামারির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ অন্য দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ঋণসহায়তা পাওয়ায় গত আর্থিক হিসাবে বড় উদ্বৃত্ত ছিল বলে জানান আহসান মনসুর।
নিয়মিত আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাব উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।
‘রেমিট্যান্স কমছে। বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে রপ্তানি আয় বাড়ারও কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। সে কারণে গত অর্থবছরের মতো এবারও বড় বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যার ফলশ্রুতিতে ব্যালান্স অফ পেমেন্টেও বড় ঘাটতি হবে বলে মনে হচ্ছে,’ বলেন আহসান এইচ মনসুর।