প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পর অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক রপ্তানি আয়েও বড় ধাক্কা লেগেছে।
সদ্য শেষ হওয়া অক্টোবর মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪৩৫ কোটি ৬৬ লাখ (৪.৩৫ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয় কম প্রায় ১৩ শতাংশ।
রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজার ইউরোপ-আমেরিকার লোকজন পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। তার প্রভাবে রপ্তানি আয় কমছে।
১৩ মাস পর গত সেপ্টেম্বরে ঋণাত্মক (নেগেটিভ) প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। ওই মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার আয় করেন রপ্তানিকারকরা, যা ছিল গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ কম। সেই ধারাবাহিকতায় অক্টোবরেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই চার মাসে লক্ষ্যের চেয়ে রপ্তানি কমেছে শূন্য দশমিক ৭৪ শতাংশ। তবে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় বেড়েছে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক মঙ্গলবার রেমিট্যান্সের যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, অক্টোবর মাসে গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে রেমিট্যান্স কমেছে ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বুধবার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ৫ বিলিয়ন ডলার। আয় হয়েছে ৪ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের অক্টোবরে আয় হয়েছিল ৪ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।
এ হিসাবেই অক্টোবর মাসে লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ১২ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
তবে অর্থবছরের চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) হিসাবে প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। এই চার মাসে রপ্তানির লক্ষ্য ছিল ১৭ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি হয়েছে ১৬ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় বেড়েছে ৭ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমেছে ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ।
জুলাই-অক্টোবর সময়ে প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক থেকে আয় হয়েছে ১৩ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের এই চার মাসে আয় হয়েছিল ১২ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই চার মাসে লক্ষ্যের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছে শূন্য দশমিক ৭৪ শতাংশ। তবে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় বেড়েছে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক মঙ্গলবার রেমিট্যান্সের যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, অক্টোবর মাসে গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে রেমিট্যান্স কমেছে ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
আড়াই বছরের করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে দেশের অর্থনীতি নিয়ে নানা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছিল। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর থেকে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের প্রধান এই দুই সূচকেও দুঃসংবাদ এসেছে।
আর এই দুই সূচকে নেতিবাচক ধারার কারণে বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে সবচেয়ে স্পর্শকাতর সূচক রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। গতকাল দিন শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার।
১৩ মাস পর সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধিতে হোঁচট খায় বাংলাদেশ। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে আগের বছরের জুলাইয়ের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছিল ৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। এর পর থেকে এক বছরের বেশি সময় রপ্তানি আয়ে বড় প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল। ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষ হয়েছিল।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে এসে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
গত অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে আগের বছরের জুলাইয়ের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছিল ৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। এর পর থেকে এক বছরের বেশি সময় ধরে রপ্তানি আয়ে বড় প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল। ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। কিন্তু সেপ্টেম্বরে এসে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই অক্টোবরে গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে রপ্তানি আয় কমলেও গত সেপ্টেম্বরের চেয়ে কিন্তু বেশ খানিকটা বেড়েছে।
সেপ্টেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছিল। অক্টোবরে এসেছে ৪ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে কিন্তু সেপ্টেম্বরের চেয়ে অক্টোবরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১১ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
মোট রপ্তানি ৮৩ শতাংশই এসেছে পোশাক থেকে
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি মূলত তৈরি পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি কমার কারণে কমছে। গত অর্থবছরে সার্বিক রপ্তানিতে ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল আরও বেশি, ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
কিন্তু চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের চার মাসে অর্থাৎ জুলাই-অক্টোবর সময়ে সেই প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশে। এই চার মাসে ১৩ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে আয় হয়েছিল ১২ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জুলাই-অক্টোবরে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ দশমিক ৭৮ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে।
অন্যান্য পণ্য
অন্যান্য পণ্যের মধ্যে এই চার মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি কমেছে প্রায় ২ শতাংশ। হিমায়িত মাছ রপ্তানি কমেছে প্রায় ২৪ শতাংশ। কৃষিপণ্য রপ্তানি কমেছে ২৩ দশমিক ৮১ শতাংশ। ওষুধ রপ্তানি কমেছে ২৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
তবে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে ১৭ দশমিক ৪২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। হোম টেক্সটাইল রপ্তানি বেড়েছে ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ।
আগামী দিনগুলোতে আরও কমার শঙ্কা
পোশাকশিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এবং বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান দুই বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় তারা পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। তাদের এখন খাদ্যের পেছনেই অনেক বেশি খরচ করতে হচ্ছে। সে কারণে আমাদের রপ্তানি আয় কমছে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থা বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা করছে। এ অবস্থায় আগামী দিন আমাদের রপ্তানি আয়ে সুখবর নেই বলেই মনে হচ্ছে।’
‘তবে খুব বেশি আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই’ জানিয়ে দেশের অন্যতম শীর্ষ পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইভিন্স গ্রুপের কর্ণধার পারভেজ বলেন, ‘এ কথা ঠিক যে বিশ্ব পেক্ষাপটে আমাদের এবার প্রবৃদ্ধি কম হবে। তবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি নিয়েই অর্থবছর শেষ হবে। কেননা আমরা ইতিমধ্যে চীনের বাজার বেশ খানিকটা দখল করতে পেরেছি। ভিয়েতনাম-মিয়ানমারের কিছু অর্ডারও বাংলাদেশে আসছে। পাশের দেশ ভারতে আমাদের রপ্তানি বাড়ছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমরা অতিপ্রয়োজনীয় কম দামি পোশাক বেশি রপ্তানি করি। বিশ্ব অর্থনীতির পরিস্থিতির অবস্থা যত খারাপই হোক না কেন, অতি প্রয়োজনীয় পোশাক কিন্তু সবার কিনতেই হবে। তাই সব মিলিয়ে আমি খুব একটা চিন্তিত নই।’
অর্থনীতিবিদ গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যে দুই সূচক এতদিন অর্থনীতিকে সামাল দিয়ে আসছিল, সেই দুই সূচক ধাক্কা খাওয়ায় অর্থনীতিতে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিল। বেশ চাপের মধ্যে পড়ল অর্থনীতি। আগামীতে এই দুই সূচক বাড়বে বলে মনে হয় না। সে কারণে রিজার্ভ আরও কমবে বলে মনে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। দু-এক দিনের মধ্যে আকুর (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ আরও কমে আসবে। তখন কিন্তু আমাদের অর্থনীতিতে চাপ আরও বেড়ে যাবে।’