বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

হিম হিম ঠান্ডা দিনের সেই কিউট কোল্ড ক্রিম

  •    
  • ২ নভেম্বর, ২০২২ ১৬:৩১

মুক্তবাজার অর্থনীতির দাপটে ধীরে ধীরে বাজার দখলে নিয়েছে বিদেশি প্রসাধন সামগ্রী। দেশের নামি ব্র্যান্ডের অনেক পণ্যই এখন উধাও, কিছু ব্র্যান্ড টিকে আছে কোনোমতে। তবে বিশাল এই ধাক্কার মধ্যেও বেশ ভালোভাবে ব্যবসা ধরে রেখেছে কিউটের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান।

‘হিম হিম ঠান্ডা এমন দিনে চাই কিউট কোল্ড ক্রিম...’। ১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে এই বিজ্ঞাপনে মন আন্দোলিত হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। শীতের রুক্ষতা থেকে ত্বকের সুরক্ষায় কিউট কোল্ড ক্রিম সে সময় ছিল দারুণ জনপ্রিয়।

শহরের পাশাপাশি গ্রামেও প্রায় একচেটিয়া বাজার ছিল দেশীয় এই পণ্যের। শুধু কোল্ড ক্রিম নয়, গরমে কিউটের ট্যালকম পাউডারের চাহিদাও ছিল তুঙ্গে।

তবে মুক্তবাজার অর্থনীতির দাপটে ধীরে ধীরে বাজার দখলে নিয়েছে বিদেশি প্রসাধনসামগ্রী। দেশের নামি ব্র্যান্ডের অনেক পণ্যই এখন উধাও, কিছু ব্র্যান্ড টিকে আছে কোনোমতে। তবে বিশাল এই ধাক্কার মধ্যেও বেশ ভালোভাবে ব্যবসা ধরে রেখেছে কিউটের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান।

৯০ এর দশকে কিউট ব্র্যান্ডের ট্যালকম পাউডারের একটি বিজ্ঞাপন

অবশ্য ভোক্তার ধরনে এসেছে বড় পরিবর্তন। কিউটের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান মৌসুমী ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃপক্ষ বলছে, আগে প্রায় সব ধরনের ভোক্তা কিউটের বিভিন্ন পণ্য ব্যবহার করলেও এখন নিম্নবিত্তের ভোক্তার সংখ্যাই বেশি। শিল্প ও পোশাক কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের পছন্দের শীর্ষে আছে কিউট।

ভোক্তা বাড়লেও প্রসাধনীর বাজারে কমেছে অংশীদারত্ব

বাংলাদেশ কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিজ ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিটিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার প্রসাধন পণ্য বিক্রি হয়, এর বেশির ভাগের দখল বিদেশি কোম্পানির কাছে। বিদেশি কোম্পানির নামে নকল পণ্যও বিক্রি হচ্ছে প্রচুর।

প্রতিকূল এই পরিস্থিতিতেও আগের চেয়েও বড় হয়েছে কিউটের পণ্যের বাজার। তবে, প্রসাধনীর বাজারে মোট চাহিদার সঙ্গে তুলনা করলে কমেছে কিউটের অংশীদারত্ব বা মার্কেট শেয়ার।

মৌসুমী ইন্ডাস্ট্রিজ উৎপাদিত কিউটের মোট ১৩৬টি পণ্য রয়েছে। এর মধ্যে নিয়মিত ৭০ থেকে ৮০টি পণ্য বাজারজাত করা হয়। পণ্যের কাঁচামাল প্রধানত ইউরোপ থেকে আনা হয়। নতুন কিছু পণ্যের কাঁচামাল আসে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও চীন থেকে।

প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় ঢাকার বংশালে, আর কারখানা রয়েছে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের কিউটপল্লিতে। প্রধান কার্যালয় ও কারখানায় সব মিলিয়ে সাড়ে তিন হাজার কর্মী কাজ করছেন বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

শীত মৌসুমে কিউট ব্র্যান্ডের ১৩ থেকে ১৫টি পণ্য বাজারজাত করা হচ্ছে। এর মধ্যে আছে রিফাইন পেট্রোলিয়াম জেলি, ভেসলিন, কোল্ড ক্রিম, ক্র্যাক ক্রিম, পমেড, লিপ জেল ও বিভিন্ন ফ্লেভারের লোশন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় কোল্ড ক্রিম।

মৌসুমী ইন্ডাস্ট্রিজের সহকারী নির্বাহী পরিচালক (উৎপাদন প্রধান) কাজী সাদ ইবনে মইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৯৯০-এর দশকে কোল্ড ক্রিম বাজারে আসার পর এখনও এ ক্রিমের দাপট কমেনি। একসময় বাংলাদেশে একচেটিয়া ব্যবসা করেছে কিউট।’

একসময় শীর্ষ অভিনেতাদের দিয়ে কিউটের বিজ্ঞাপন করা হতো

তিনি বলেন, ‘তখন দেশের মানুষ দেশীয় পণ্য ব্যবহারে লজ্জাবোধ করত না। আর এখনকার ট্রেন্ড হচ্ছে, দেশীয় পণ্য যতই ভালো হোক বাইরের পণ্য ব্যবহার করা। মানসিকতা পরিবর্তনের কারণে এমন অবস্থা হয়েছে। বর্তমান শহুরে প্রজন্ম এসব পণ্য ব্যবহার করবে না। এ জন্য এদের টার্গেট কাস্টমার বানানোর চেষ্টা বৃথা।’

কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাজার চাহিদা বিবেচনায় কিউট ব্র্যান্ডে নতুন পণ্য যোগ হয়েছে। ১৯৯৫ সালে প্রথম লোশন বাজারে আনা হয়। এরপর বেবি লোশনসহ আরও কিছু পণ্য এসেছে।

১৯৯২-৯৩ সালের দিকে মৌসুমী ইন্ডাস্ট্রিজ লিপস্টিক উৎপাদন ও বাজারজাত শুরু করে। তবে দুই থেকে তিন বছর পর এই পণ্যের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়। বাজারে অসম প্রতিযোগিতাই এর কারণ বলে দাবি করছে কর্তৃপক্ষ।

১৯৯৯ সালে পারফিউম বাজারে আনে মৌসুমী ইন্ডাস্ট্রিজ। প্রথমে দুটি পণ্য বাজারজাত করার পর এখন তা বেড়ে আটটিতে পৌঁছেছে। এই কোম্পানির আতরও রয়েছে বাজারে।

সুগন্ধি সামগ্রীরও বিভিন্ন পণ্য রয়েছে কিউটের

দেশে বিপুল জনগোষ্ঠী যখন দাঁত মাজতে পাউডারে অভ্যস্ত ছিল, তখন টুথপেস্ট উৎপাদন শুরু করে করে মৌসুমী ইন্ডাস্ট্রিজ। এ জন্য করা হয় বড় অঙ্কের বিনিয়োগ। টুথপেস্টের উপাদান ও মেশিনারিজ আনা হয় ইংল্যান্ড থেকে। এখনও বাজারে আছে এই কোম্পানির টুথপেস্ট।

প্রধান ভোক্তা নিম্ন আয়ের মানুষ

নিম্নবিত্তের মানুষের মধ্যে কিউটের পণ্য এখনও বেশ এখনও বেশ জনপ্রিয়। কোম্পানির কর্তৃপক্ষ বলছে, গ্রাম এবং মফস্বলে বসবাসরতদের ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় রেখে তারা পণ্য উৎপাদন করছে।

কোম্পানির সহকারী নির্বাহী পরিচালক (উৎপাদন প্রধান) কাজী সাদ ইবনে মইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সব সময় গ্রাহকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে পণ্যের দাম রাখার দিকটি বিবেচনা করে থাকি। দেশের মধ্যে অঞ্চলভিত্তিক বিভাজন করা হয়। এরপর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা হয়, কোন এলাকার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কতটুকু। তারা পণ্যের পেছনে কতটুকু খরচ করতে পারবেন সেটাও আমরা পর্যালোচনা করি।’

এমন নানা পণ্য গ্রামীন জনগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে তৈরি করছে কিউটের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান মৌসুমী ইন্ডাস্ট্রিজ

তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের লাক্সারি বা বিলাসদ্রব্যও আছে। তবে কোম্পানির অধিকাংশ গ্রাহক নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির, যাদের মাসিক আয় সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। বিভিন্ন শিল্পকারখানা, গামের্ন্টসে কর্মরত শ্রমিকই আমাদের পণ্যের মূল ক্রেতা। তাদের আয়ের বিষয়টি মাথায় রেখেই পণ্য বাজারজাত হয়।’

কর্তৃপক্ষের দাবি, প্যাকেজিং, কাঁচামাল, মার্কেটিং সবকিছু মিলিয়ে পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়। যে পণ্য ৫০ টাকায় বিক্রি হবে সেটার কাঁচামাল ও প্যাকেজিং ব্যয় হয় ৩০ বা ৩২ টাকা। দোকান ও পরিবেশক কমিশন আরও ১০ বা ১২ টাকা। এরপর লাভ থাকে ৩ বা ৪ টাকা।

কীভাবে এলো কিউট

মৌসুমী ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কোম্পানির একটি ব্র্যান্ড ‘কিউট’। ১৯৭২ সালে এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর দুটি ব্র্যান্ডের অধীনে প্রসাধনসামগ্রী উৎপাদন শুরু হয়, যার একটি কিউট, অন্যটি লাবনি।

মূলত চার ভাই মিলে তৈরি করেন এই প্রতিষ্ঠান। চেয়ারম্যান ছিলেন প্রয়াত কাজী মাহতাব উদ্দিন আহমেদ। প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন প্রয়াত কাজী আশরাফ উদ্দিন আহমেদ। আর পরিচালক ছিলেন কাজী মঈন উদ্দিন আহমেদ ও কাজী রাজীব উদ্দিন আহমেদ।

বর্তমানে কাজী মঈন উদ্দিন আহমেদ কোম্পানির এমডি ও কাজী রাজীব উদ্দিন আহমেদ চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন। এ ছাড়া আরও দুইজন পরিচালক আছেন কোম্পানিতে।

১৯৮৪ সালে আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের কাঁচপুরে ৬২ একর জায়গার ওপর নির্মাণ হয় কিউটপল্লি।

প্রসাধনী বাজারজাত করার পরপরই কিউট ব্র্যান্ডটি সারা দেশে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। মৌসুমী ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে গঠিত হয় ১৯৮২ সালে।

১৯৯০ সালে ওমানে পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে রপ্তানির খাতায় নাম লেখায় মৌসুমী ইন্ডাস্ট্রিজ। এই প্রতিষ্ঠানের পণ্য এখন ওমান, সৌদি আরব, কেনিয়া, সুদান, ভারত, ভুটান, মিয়ানমার, নেপাল ও পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।

নিভৃত মার্কেটিং

এক সময় কিউটের পণ্যের প্রচারে টেলিভিশনসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক বিজ্ঞাপন দেয়া হলেও এখন তা প্রায় বন্ধ। অনেকটা নিভৃতে চলছে এই ব্র্যান্ডের পণ্যের বিপণন।

কোম্পানির সহকারী নির্বাহী পরিচালক (উৎপাদন প্রধান) কাজী সাদ ইবনে মইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পণ্য বাজারজাত করতে আমবা বিজ্ঞাপনের পেছনে এখন অর্থ ব্যয় করি না। কোনো পণ্যের মার্কেটিং বাজেট যদি হয় ৫০ লাখ টাকা, সে টাকা তো বিভিন্নভাবে পণ্যের ব্যয়ের মধ্যে ভাগ করতে হবে। এ খরচ সমন্বয় করতে গেলে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এ জন্য মার্কেটিং বাবদ তেমন ব্যয় করে না আমাদের কোম্পানি।’

বাণিজ্য মেলায় কিউট ব্র্যান্ডের একটি স্টল

তিনি দাবি করেন, ‘মার্কেটিং বাবদ যে ব্যয় হতো সেটি আমরা পণ্যের গুণগত মান ঠিক রাখার কাজে ব্যবহার করি। বিজ্ঞাপনের পেছনে টাকা ব্যয় না করে মান ঠিক রাখাই আমাদের মূল লক্ষ্য।’

এ বিভাগের আরো খবর