খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা সে বিষয়েও জানতে চেয়েছে বহুজাতিক ঋণদাতা সংস্থাটি।
রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে।
সরকার আইএমএফের কাছে বাজেট সহায়তা হিসেবে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটির ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল আলোচনার জন্য বাংলাদেশ সফর করছে। তারই অংশ হিসেবে আইএমএফের বাংলাদেশ মিশন প্রধান রাহুল আনান্দের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর ও প্রধান অর্থনীতিবিদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের মতো বৈঠক করে।
বৈঠক প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, আগের দিনের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আজও (রোববার) আইএমএফের সঙ্গে ফলপ্রসূ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আইএমএফ মিশনের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের আলোচনা আরও কয়েকদিন চলবে।
তিনি বলেন, এক্সটেন্ডেন্ট ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি, র্যাপিড ফাইন্যান্সিং ইনস্ট্রুমেন্ট ও র্যাপিড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি- এই তিনটি স্কিমের আওতায় দেড় বিলিয়ন করে মোট সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ চাওয়া হয়েছে আইএমএফের কাছে। ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক আশাবাদী। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, খেলাপি ঋণ ছাড়াও মুদ্রানীতি, বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি, ঋণের সুদ ও মুদ্রার বিনিময় হার, সঞ্চয়পত্রের সুদ হার, বন্ড ব্যবস্থাপনাসহ বেশ কিছু বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এসব আলোচনায় আইএমএফের বিভিন্ন প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে।
সূত্রমতে, দেশের খেলাপি ঋণ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইএমএফের প্রতিনিধি দল। বর্তমানে খেলাপি ঋণ সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তারা খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে। পাশাপাশি ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ ও পুনর্গঠন সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের মাস্টার সার্কুলার প্রসঙ্গেও জানতে চেয়েছে আইএমএফ।
প্রসঙ্গত, এই সার্কুলারে ঋণ খেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিলিকরণে আরও বেশি ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মুদ্রানীতি বিষয়ক বৈঠকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে সে বিষয়েও জানতে চায় আইএমএফ। তারা বছরে চারবার মুদ্রা নীতি প্রণয়নের পরামর্শ দেয়।
এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, বছরে চার বার মুদ্রানীতি প্রণয়ন সম্ভব নয়। কেননা মুদ্রানীতিতে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সূচক বছরে এক বা দু’বারই প্রকাশ করা হয়ে থাকে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকও এখন থেকে বছরে দু’বার মুদ্রানীতি প্রণয়ন করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আইএমএফ সুনির্দিষ্ট করে কোনো শর্ত দেয়নি। তবে আর্থিক খাতের সংস্কার, নীতি ও ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা চায় সংস্থাটি।
বৈঠকে ডলার তথা বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়েও আলোচনা হয়েছে। আইএমএফ প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ডলারের ভিন্ন ভিন্ন রেট সম্পর্কে জানতে চায়। জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের রেট ৯৭ টাকা আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর রেট বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
বিনিময় হার নির্ধারণে বিভিন্ন পর্যায়ে (আমদানি, রপ্তানি, ক্যাশ, ব্যাংক থেকে ব্যাংকে বিক্রি ও ধার, কার্ড) দর ব্যবধান কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নিতে বলেছে আইএমএফ।
এ বিষয়ে মুখপাত্র বলেন, বর্তমান বিনিময় হার নির্ধারণের প্রক্রিয়া সাময়িক। একটি অস্থিতিশীল সময়ে কিছু ফটকাবাজি (স্পেকুলেশন) হয়। আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিময় হার নির্ধারণে একটি ইউনিফাইড ফর্মুলা নির্ধারণ করবে। তাতে করে বিনিময় হার নির্ধারণের এই ব্যবধান কমে আসবে।
এছাড়া বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক, সাম্প্রতিক মনিটরি পলিসির হালনাগাদ তথ্য, অর্থনীতির বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিভিন্ন নীতি সংস্কার নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।
সংস্কার ইস্যুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে মুখপাত্র বলেন, সংস্কার হচ্ছে বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয়। অর্থমন্ত্রী তা আগেই প্রস্তাব রেখেছিলেন। তার সঙ্গে এই সংস্কার কাজ সম্মিলিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আইএমএফ প্রতিনিধি দলটি সোমবার এবং ২ ও ৮ নভেম্বর আবারও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করবে।