রাজস্ব আদায় বাড়তে কর অব্যাহতি সুবিধা কমানোর তাগিদ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। তাদের যুক্তি, এই পদক্ষেপ নিলে রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক বহুজাতিক ঋণদাতা সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় কর আহরণ কম হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে আয়কর, মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাট ও আমদানি শুল্কে ব্যাপক মওকুফ সুবিধা দেয়া। এসব সুবিধা কমিয়ে আনলে রাজস্ব আদায় বাড়বে।
রোববার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় জাতীয় রাজস্ব বার্ডের (এনবিআর) নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠকে এসব কথা বলেছে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধি দল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বৈঠকে রাজস্ব আহরণের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চায় আইএমএফ। চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাড়তি রাজস্ব আহরণের পরিকল্পনা সম্পর্কেও জানতে চায় সংস্থাটি।
ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন বা ইন্টিগ্রেশনের ওপর জোর দিয়েছে আইএমএফ। ভ্যাট বিভাগ ও কাস্টমসের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা যায় কিনা- সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখতে বলেছে সংস্থাটি।
নতুন কাস্টমস আইনের খসড়া তৈরি শুরু হয় ২০১২ সালে এবং আয়কর আইন হয় ২০১৭ সালে। এতদিনেও এই দুটি আইন বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। খসড়া আইনটি কোন অবস্থায় আছে সে বিষয়েও জানতে চাওয়া হয়।
বৈঠকে এনবিআরের পক্ষ থেকে রাজস্ব আদায়ের বর্তমান পরিস্থিতি ও সংস্কারবিষয়ক কার্যক্রম তুলে ধরা হয়। ভ্যাট, কাস্টমস ও আয়কর বিভাগ থেকে তিনটি পৃথক অবস্থানপত্র তুলে ধরা হয়।
আয়কর বিষয়ে এনবিআরের সদস্য আয়কর (নীতি) সামছুদ্দিন আহমেদ, ভ্যাট বিভাগের পক্ষে সদস্য (নীতি) জাকিয়া সুলতানা ও কাস্টমসের পক্ষে সদস্য শুল্ক (নীতি) মাসুদ সাদিক অবস্থানপত্র উপস্থাপন করেন ।
ঋণ নিয়ে আলোচনা করতে ১০ সদস্যের আইএমএফ স্টাফ মিশন বুধবার ঢাকায় এসেছেন। এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনান্দ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
ঢাকায় অবস্থানকালে প্রতিনিধি দল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থবিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। সিরিজ বৈঠকের অংশ হিসেবে রোববার এনবিআরের সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফ। এছাড়া রোববার এনবিআরের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিকেলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে তারা।
বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের অর্থনীতিতে যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে তা মোকাবিলায় আইএএমএফের কাছ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ইতোমধ্যে তিন কিস্তিতে ঋণ দেয়ার আভাস মিলেছে।
তবে এ ঋণ পেতে বরাবরের মতো এবারও বেশি কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে সরকারকে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাজস্ব খাতে সংস্কার। তারই অংশ হিসেবে এনবিআরের সঙ্গে এই বৈঠক করে আইএমএফ।
সূত্র জানায়, রোববার এনবিআরের ভ্যাট, আয়কর ও কাস্টমস নীতি বিভাগের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে করে আইএমএফ প্রতিনিধি দল। সকাল ১০টা থেকে শুরু হওয়া এ বৈঠক চলে বেলা ২টা পর্যন্ত।
এরপর এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত বৈঠক করে আইএমএফের পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল।
এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ‘বৈঠকে রাজস্ব খাতের নানা বিষয় আলোচনায় উঠে এলেও আইএমএফের পক্ষ থেকে মূলবিষয় ছিল কর অব্যাহতি। আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস- তিনটি খাতেই অব্যাহতি কমানোর তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি।
কোন কোন খাতে কর অব্যাহতি দেয়া আছে তার তালিকা সম্পর্কে জানতে চায় প্রতিনিধি দল। বৈঠকে পর্যালোচনা করে ক্রমান্বয়ে এ সুবিধা কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।
বৈঠকে এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশের বৃহত্তর অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে বিভিন্ন সময়ে এসব সুবিধা দেয়া হয়েছে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিকশিত হয়। উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়ে। কাজেই, কর অব্যাহতি কমালে বা বাতিল করলে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। তবে প্রতিবছর বাজেটে কিছু কিছু খাতে অব্যাহতি কমানো হচ্ছে।
জানা যায়, আয়কর নীতি বিভাগের সঙ্গে বৈঠকে কর জাল বাড়ানোর কথা বলেছে আইএমএফ। তারা নতুন আয়কর আইনের হালনাগাদ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চায়। এছাড়া কর আদায় বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সম্পর্কেও জানতে চাওয়া হয়।
বর্তমানের করদাতা শনাক্তকরণ সংখ্যা ৭৭ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কর জাল বাড়াতে বিআরটিএ, বিডা, ডিপিডিসিসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে চুক্তি করা হয়েছে। আরও কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে চুক্তি প্রক্রিয়াধীন।
এ ছাড়া চলতি বাজেটে ৩৮ ধরনের সেবা পেতে আয়কর বিবরণী ও প্রাপ্তি স্বীকারপত্র জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আয়কর আহরণের সবচেয়ে বড় খাত উৎসে কর ব্যবস্থাপনায় অটোমেশন করা হয়েছে। ই-টিআইএন প্রক্রিয়া স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হয়েছে। নতুন আয়কর আইনের খসড়া সহজ করা হয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে কর জাল আরও বাড়বে।
কাস্টমস বিভাগের সঙ্গে আলোচনায় নতুন আইন দ্রুত বাস্তবায়নের কথা বলেছে আইএমএফ। এনবিআর বলেছে, প্রস্তাবিত আইনটি পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্য জাতীয় সংসদে রয়েছে।
বাংলাদেশে আমদানি শুল্কের গড় সংরক্ষণ হার বা এভারেজ প্রোটেকশন রেট ২৮ থেকে ২৯ শতাংশ এবং গড় শুল্ক হার ১৪ শতাংশ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এই হার অনেক বেশি বলে মনে করে আইএমএফ। অন্যান্য দেশের সঙ্গে সামাঞ্জস্য রেখে এটি যৌক্তিক করার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
এনবিআর বলেছে, দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা দিতে গড় শুল্ক হার বেশি রাখা হয়েছে। তবে প্রতি বছর বাজেটে এটি কমানো হচ্ছে।
নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে বহুজাতিক সংস্থাটি ভ্যাট অব্যাহতি আরও কমিয়ে আদায় বাড়াতে বলেছে।
এনবিআর বলেছে, আদায় বাড়াতে আধুনিক প্রযুক্তির ভ্যাট মেশিন বা ইএফডি বসানো হয়েছে। এ কাজসম্পন্ন হলে ভ্যাট আহরণ অনেক বাড়বে।
আইএমএফ বরাবরই অভিযোগ করে আসছে যে অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ শুল্ক-কর সুবিধা বেশি দেয়া হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে জিডিপির তুলনায় কর আহরণের অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে, যা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম। কম রাজস্ব আহরণের অন্যতম কারণ বেশি অব্যাহতি সুবিধা বলে মনে করা হয়।
এজন্য সুবিধা কমানোর তাগিদ দিয়ে আসছে সংস্থাটি। তাদের মতে, বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত হওয়া উচিত কমপক্ষে ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ।
এনবিআরের সাবেক সদস্য রেজাউল হাসান এ বিষয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আইএমএফের দাবি সঠিক নয়। ভ্যাট ও কাস্টমসে যেসব অব্যাহতি দেয়া আছে তার যৌক্তিকতা আছে। এই সুবিধা তুলে দিলে গরিবের ওপর চাপ আসবে।
‘উৎপাদন, সেবা, আমদানিসহ পাঁচটি স্তরে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেয়া আছে। এসব সুবিধা চায় না আইএমএফ। তারা মনে করে, এটি আধুনিক ভ্যাট আইনের পরিপন্থি। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ ব্যবসায়ী ছোট কলেবরের। তারা সিস্টেমে হিসাব সংরক্ষণ করতে পারে না। যে কারণে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আইএমএফ তাতে আপত্তি তুলেছে। ছোট ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দেয়া সরকারের দায়িত্ব।’
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে ভ্যাটে ৭২টি আদেশ রয়েছে অব্যাহতি সংক্রান্ত। আমদানি খাতে ২৩১টি পণ্য ভ্যাটের আওতার বাইরে। ব্যবসায়ী ও উৎপাদন পর্যায়ে আছে দুই শতাধিক। কৃষি পণ্য ভ্যাটমুক্ত। এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে ৩৮টি সেবা খাতে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া আছে। মেগা প্রকল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশও ভ্যাট এবং শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে।
আয়কর অব্যাহতির তালিকাও বেশ লম্বা। প্রায় ৫৮টি খাত করমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে। এর বাইরে অনেক খাত থেকে হৃাসকৃত বা বর্তমানের চেয়ে কম হারে কর আদায় করা হয়। বিদ্যুৎ খাত পুরোপুরি করমুক্ত।
বিভিন্ন খাতে কর অব্যাহতির নামে কী পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হয়, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই এনবিআরের কাছে। তবে ধারণা করা হয়, ভ্যাট আমদানি শুল্ক ও আয়কর খাতে অব্যাহতির নামে বছরে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আয় হয়।
জানা যায়, কর অব্যাহতির বিষয়ে গত বছর একটি সমীক্ষা চালায় এনবিআর। তাতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন খাতে অব্যাহতি দেয়ার ফলে প্রতি বছর রাজস্ব ক্ষতি হয় মোট জিডিপির ২ দশমিক ২৮ শতাংশ।
এনবিআরের সাবেক সদস্য আমিনুর রহমান বলেন, ‘এ কথা সত্য যে আমাদের দেশে কর অব্যাহতি বেশি। অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় এ সুবিধা দেয়া হয়। এটা ঠিক নয়। এজন্য কর অব্যাহতির তালিকা পর্যালোচনার সময় এসেছে। তবে ভেবেচিন্তে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রেজোয়ান রাহমান বলেন, ‘কর অব্যাহতি তুলে দেয়া ঠিক হবে না। এটা করা হলে ব্যবসার খরচ আরও বাড়বে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে বৈঠক
এদিকে এনবিআরের সঙ্গে বৈঠক শেষে রোববার বিকেলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফ।
সূত্র জানায়, বৈঠকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি। পাশাপাশি ব্যাংক কোম্পানি আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।