বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নিত্যপণ্যের বাড়তি দরে ‘গরিবগঞ্জের পরিস্থিতি’

  •    
  • ৩০ অক্টোবর, ২০২২ ০৮:২৪

বাড়তি ব্যয় সামাল দিতে কেউ শখ আহ্লাদের পেছনে ব্যয় কমাচ্ছে, কেউ সন্তানদের পেছনে ব্যয় কমাচ্ছে, কেউ ঘোরাঘুরি বাদ দিচ্ছে, কাপড় কম কিনছে, বাজারে কম দামি মাছ ও সবজি কিনছে, কেউ আড্ডায় কম যাচ্ছে, বিয়েসহ সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ না নেয়া, কেউ বা রিকশা বাদ দিয়ে হাঁটছেন, বাসার গৃহকর্মী বাদ দিয়েছেন সন্তানকে প্রাইভেট টিউশন দেয়ার বদলে নিজেই পড়াচ্ছেন। এই খরচ কমিয়ে দেয়ায় আবার অর্থনীতিতে পড়ছে টাকার টান। যেমন পাড়ার খাবারের দোকানে বিক্রি কমে গেছে, ফুটপাতে ভ্যানের ফল বিক্রেতারও আয় আগের মতো নেই।

কবি তারাপদ রায়ের কবিতা ‘গরিবগঞ্জের রূপকথা’র মতো পরিস্থিতি অনেকটা। কবির সেই বড়সড় গ্রামটি গরিব, কারণ সেখানে টাকা নেই। এ কারণে কলের চাকাও নেই। যেহেতু কলের চাকা নেই, তাই মানুষের হাতে টাকাও নেই।

নিত্যপণ্যের দর বাড়ছে, এ কারণে মানুষ তার সংসারের খরচ কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে। আর যে খাতে খরচ কমাচ্ছে, তাতে আবার আরেকজনের আয় কমে যাচ্ছে।সরকারি হিসাবেই এখন মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই। অর্থাৎ একই পণ্য বা সেবা নিতে গত বছর এক হাজার টাকা খরচ হলে এখন তা লাগছে ১১০০।

যে সংসারের ব্যয় ছিল ২০ হাজার, তার এখন লাগছে ২২ হাজার, যে সংসারের ব্যয় ছিল ৪০ হাজার তার এখন লাগছে ৪৪ হাজার।

বাড়তি ব্যয় সামাল দিতে কেউ শখ আহ্লাদের পেছনে ব্যয় কমাচ্ছে, কেউ সন্তানদের পেছনে ব্যয় কমাচ্ছে, কেউ ঘোরাঘুরি বাদ দিচ্ছে, কাপড় কম কিনছে, বাজারে কম দামি মাছ ও সবজি কিনছে, কেউ আড্ডায় কম যাচ্ছে, বিয়েসহ সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ না নেয়া, কেউবা রিকশা বাদ দিয়ে হাঁটছেন, বাসার গৃহকর্মী বাদ দিয়েছেন, সন্তানকে প্রাইভেট টিউশন দেয়ার বদলে নিজেই পড়াচ্ছেন।

এই খরচ কমিয়ে দেয়ায় আবার অর্থনীতিতে পড়ছে টাকার টান। যেমন পাড়ার খাবারের দোকানে বিক্রি কমে গেছে, ফুটপাতে ভ্যানের ফল বিক্রেতারও আয় আগের মতো নেই।

গৃহশ্রমিককে বাদ দিয়ে নিজেদের টিকে থাকার যে চেষ্টা, তাতে সেই গৃহশ্রমিকের সংসার কীভাবে চলবে? যে খাবার দোকানে বিক্রি কমে গেছে, সেই দোকানের উদ্যোক্তা বা কর্মচারীদের বিপত্তি আরও বেড়েছে, যে কাপড় বিক্রেতাকে বাড়তি দর পেয়েও মুখ ভার করে রাখতে হচ্ছে আগের চেয়ে কম বিক্রির কারণে, তিনি আবার চায়ের দোকানে কম যাওয়ায় চা বিক্রেতার মন খারাপ করতে হচ্ছে। কারণ বিক্রি কমে গেছে তারও।

রিকশায় না চেপে হেঁটে সাদেকুর রহমানরা দুই বেলায় হেঁটে অফিসে আসা-যাওয়া করায় তার শারীরিক কসরত হচ্ছে বটে, তবে দুই বেলায় তিনি ৫০ টাকা করে যে ১০০ টাকা দুজন রিকশাচালককে দিতেন, সেই টাকাটা এখন তারা কম পাওয়ায় তার সংসারের খরচ মেটানো হয়ে গেছে কঠিন।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কবে বা কীভাবে তা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা সুনির্দিষ্ট কোনো ধারণা দিতে পারছেন না। মূল্যস্ফীতি কমাতে দেশে দেশে যে কৌশলগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে, কাজে আসছে না সেগুলোর কিছুই। সব মিলিয়ে একটি হতাশাজনক সময়ে মানুষ।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, মানুষের এই খরচ কমানোর প্রবণতা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মানুষ ব্যয় কাটছাঁট করলে তার প্রভাব সার্বিক অর্থনীতিতে পড়বে। কারণ ব্যয় কমাতে কেউ বাইরে খাওয়া কমিয়ে দিচ্ছে, তখন রেস্টুরেন্টের ব্যবসা কমবে। ঘোরাঘুরি কম করলে পর্যটন এলাকার মানুষের জীবনমানে প্রভাব পড়বে। পোশাক কেনা কমে যাওয়ায় বস্ত্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়ও নেতিবাচক ধারা দেখা দেবে। অর্থাৎ সার্বিক অর্থনীতি চাপে পড়বে।’

অর্থনীতিতে এভাবে টাকার স্রোত কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বেতন বাড়ানোর সুপারিশ এসেছে। তবে ডলারের বিপরীতে টাকার দর কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বেতন বা মজুরি বাড়ানোর মতো পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে কি না, এ নিয়ে ও আছে প্রশ্ন।

বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মন্দার কথা বলাবলি হচ্ছে, তাতে প্রায় সব দেশের মতো ভীষণ চাপে বাংলাদেশের নির্দিষ্ট আয়ের মানুষরাও। খরচ বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু আয় বাড়ছে না। এই অবস্থায় সংসার চালানো হয়ে গেছে কঠিন।

যেভাবে টিকে আছে সংসারগুলো

বেসরকারি ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের কর্মকর্তা সাদেকুর রহমান। বাসা রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে। স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে সংসার।

নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি তার জীবনাচরণে বেশ পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, ‘আগে যাত্রাবাড়ী থেকে মতিঝিল অফিসে রিকশায় যেতাম, এখন সে পথ হেঁটে যাই।’সাদেকুর মাছ-মাংসেও খরচ কমিয়েছেন সংসারের খরচ মেটাতে গিয়ে। আগে ভাজি, তরকারি মিলিয়ে তিনটি আইটেম থাকলেও এখন খাবার টেবিলে ওঠে দুটি।

শখ-আহ্লাদ বা কিছুটা বিলাস করার সুযোগ নেই শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা শফিকুল ইসলামের। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে চারজনের সংসার।

বাড়তি ব্যয় সামাল দিতে দুই মাস আগে তিন রুমের বাসা ছেড়ে দুই রুমের বাসা নিয়েছেন। আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি বা দাওয়াত-আড্ডায় যাচ্ছেন না সিদ্ধান্ত নিয়েই। সপ্তাহে ছুটির দিন সবাই মিলে বাইরে খাওয়ার অভ্যাসটিও বাদ দিয়েছেন।

শফিকুল বলেন, ‘দুই বছরে বাসাভাড়া বেড়েছে দুই হাজার টাকা। এতদিন মেয়ে স্কুলে পড়ত। সামনের জানুয়ারিতে ছেলেকেও স্কুলে দিতে হবে। তখন খরচ আরও বাড়বে। কী করব জানি না।’

করোনার কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে কোম্পানি ভালো ব্যবসা করতে পারেনি। এ জন্য গত দুই বছরে বেতন বাড়েনি। স্ত্রী একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে চাকরি করতেন। করোনার সময় সেটি বন্ধ হয়ে আর চালু হয়নি। ফলে ব্যয় বাড়লেও কার্যত তার পরিবারের আয় এই সময়ে কমেছে।

বেসরকারি একটি কলেজের প্রভাষক আমেনা সুলতানা। তার স্বামী একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। দুই মেয়ে ও শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে বেশ সচ্ছলভাবেই চলছিল এতদিন। কিন্তু হঠাৎ করেই জীবন হয়ে গেছে এলোমেলো।

বাড়তি ব্যয় সামাল দিতে গিয়ে তিনি যা জানালেন, তার অর্থ হচ্ছে, প্রতিদিন একটি রুটিনে যন্ত্রের মতো সব করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘মাসে দু-একবার হলে গিয়ে সিনেমা দেখা, রেস্তোরাঁয় খেতে যেতাম। এখন সেটা বাদ দিয়েছি। আগে নিয়মিত বিউটি পার্লারে যেতাম, এখন সেটাও বাদ দিয়েছি। প্রতি মাসে পোশাক বাবদ যে ব্যয় ছিল সেটা এখন সংসারের অন্য কাজে ব্যয় করতে হচ্ছে। সংসারের ওপর চাপও বাড়ছে।’

বেসরকারি একটি টেলিভিশনে চাকরি করেন সজল রহমান। মিরপুর ৬০ ফিটে থাকেন। স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে সংসারের আয়ের উৎস তিনি একাই।

আমেনার মতোই অবস্থা তার জীবনেও। বলেন, ‘ছুটির দিনে পরিবারের সবাই বাইরে ঘোরাঘুরি ও রেস্টুরেন্টে খেতাম। এখন সেটা বাদ দিয়েছি। এখন ঘরেই কাটে ছুটির দিন। তাতে খরচটা বাঁচে।’

নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন টিটোন রহমান। বেতন ১৬ হাজার টাকা। ওভারটাইম কাজ করে তা ২০ হাজার হয়। স্ত্রী ও তিন বছরের এক ছেলেকে নিয়ে সাবলেটে থাকেন।

টিটোন বলেন, ‘ঘরভাড়া চার হাজার দেয়ার পর বাজার করতেই হিমশিম অবস্থা। আগে সপ্তাহে তিন দিন মাছ আর এক দিন মাংস খেতাম। কিন্তু গত তিন থেকে চার মাস মাছ সপ্তাহে দুই দিন আর মাংস মাসে দুইবার খেতে পারছি। বাচ্চাকে প্রতিদিন একটি করে ডিম খেতে দেব, তাও ডিমের দাম চড়া। এভাবে চলতে থাকলে সামনে কীভাবে সব সামাল দেব, বুঝতে পারছি না।’

আরেক ঝুঁকি ঋণের জাল

শেওড়াপাড়ার ছোট্ট একটি টিনের ঘরে বাস করেন আকলিমা খাতুন। স্বামী ও দুই মেয়ে নিয়ে তার সংসার। পাঁচ বাসায় কাজ করে মাসে আয় ৯ হাজার টাকা। আকলিমার স্বামী স্থায়ী কিছু করেন না। কাজের খোঁজে বের হয়ে কোনো কোনো দিন ফেরত আসতে হয় তাকে।

আকলিমা বলেন, ‘চার হাজার টাকা ঘর ভাড়া দেয়ার পর বাকি ৫ হাজার দিয়ে কোনটা রেখে কোনটা কিনব? চারজনের সংসারে চাল, ডাল, তেল কিনতেই সব শেষ। মাছ-মাংস তো দূরের কথা, সবজি কিনে খাব সে উপায়ও নেই। ৬০ টাকার নিচে কোনো সবজি বাজারে নেই।’

বাড়তি ব্যয় সামাল দিতে গিয়ে তিনি যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, সেটি তার ভবিষ্যৎকে আরও অনিশ্চিত করে তুলতে পারে।

আকলিমা জানান, এনজিও বা কোনো সংস্থা বা কারও থেকে টাকা ধার করছেন প্রতি মাসেই। কিন্তু এখানেও দিতে হচ্ছে চড়া সুদ। ২০ হাজার ধার নিলে দেয়া লাগে ২৫ হাজার টাকা। প্রতি মাসেই কিস্তি দিতে হয় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা।

কত বেড়েছে খরচ

পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে সেপ্টেম্বর মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। এ মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

অর্থাৎ গত বছর যা ব্যয় ছিল ১০ হাজার টাকা, চলতি বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৯১০ টাকা। এটি সামগ্রিক গড় হিসাব। ক্ষেত্রবিশেষে ব্যয় আরও বেড়েছে।যেমন চালের দাম এখন ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। কাঁচাবাজারে মানুষের ব্যয়ও বেশ বেড়ে গেছে। বেশির ভাগ সবজি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৬০ টাকার বেশি দরে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের হিসাবে দেখা গেছে, এক বছরের ব্যবধানে চালের দাম ১০ থেকে ১৩ শতাংশ বেড়েছে। তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ১৫ থেকে ২৪ শতাংশ। মানভেদে মসুর ডাল সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ, ডিমের দাম ৩১ শতাংশ, লবণ ১২ শতাংশের ওপরে, লেখার কাগজ ২২ শতাংশ, গুঁড়া দুধ মানভেদে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ বেড়েছে। তরল দুধের দর এই সময়ে ৭৫ টাকা থেকে বেড়ে ৯৫ টাকা হয়ে গেছে।

বেতন বাড়ানোর পরামর্শ

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাড়তি ব্যয় নির্বাহে সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের বিশেষ ইনক্রিমেন্ট দেয়া যেতে পারে। সরকারি নিম্নপদে কর্মরতদের জন্য বিশেষ ইনক্রিমেন্ট সরকার বিবেচনা করবে। আর বেসরকারিদের ক্ষেত্রে সরকারের অনুরোধে তারা বিষয়টি বাস্তবায়ন করবে। শ্রমিক ও অন্য পেশাজীবীদের মজুরি পুনর্নির্ধারণও দরকার। এখানেও সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে।

হতদরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানোর পরামর্শও এসেছে। তিনি বলেন, ‘এসব বিষয় বিবেচনা করে আয় যদি কিছুটা স্বাভাবিকের কাছাকাছি রাখা যায়, তাহলে অন্তত ভোগে কাটছাঁট করতে হবে না। মানুষের জীবনযাত্রায় যেসব খাত জড়িত সেসব সংযুক্ত খাতগুলোতে নেতিবাচক প্রভাবের মাত্রা কম থাকবে।’

অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘মানুষের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, এর সুষ্ঠু বণ্টন যেন হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর