আগের দিন ফ্লোর প্রাইসে লেনদেন হয়েছিল ২৩৭টি কোম্পানির শেয়ার। সেই সংখ্যাটি হলো ২১৯। বুধবার দর বেড়েছে বা কমেছে এমন কোম্পানির সংখ্যা ছিল ১১৭, সেটি বেড়ে হয়েছে ১৩২-এ। সেই সঙ্গে পাঁচ কর্মদিবস পর লেনদেন ছাড়িয়েছে হাজার কোটির ঘর।
ফ্লোর প্রাইস ও চেক নগদায়ন ইস্যুতে চাপে পড়া পুঁজিবাজারে সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসইতে বৃহস্পতিবারের এই চিত্র বিনিয়োগকারীদের মনের ভার হয়তো কাটায়নি, তবে কেউ কেউ পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়ানোর সূক্ষ্ম ইঙ্গিত পেলেও পেতে পারেন।
টানা তৃতীয় দিন দরপতন হওয়া কোম্পানির তুলনায় দর বৃদ্ধি পেয়েছে, এমন কোম্পানির সংখ্যা ছিল বেশি। এদিন বেড়েছে ৭৩টি কোম্পানির দর, বিপরীতে দর হারিয়েছে ৫৯টি। আর আগের দিনের দরে লেনদেন হয়েছে ২১৯টি কোম্পানি, যেগুলোর প্রায় সবগুলোই বেঁধে দেয়া সর্বনিম্ন দর বা ফ্লোর প্রাইসে রয়েছে।
দিন শেষে ডিএসইর সাধারণ সূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে ৩৩ পয়েন্ট, অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৬৩৭৭ পয়েন্টে।
অব্যাহত দরপতনের মধ্যে গত ৩১ জুলাই থেকে দ্বিতীয় দফায় ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর টানা দূই মাস সূচক ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এই সময়ের মধ্যে ৬০০ পয়েন্টের বেশি সূচক থাকলেও বিপুলসংখ্যক কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর থেকে উঠতে না পারা নিয়ে আক্ষেপ অবশ্য ছিল।
এর মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ, বাংলাদেশের রিজার্ভে পতন, বিদ্যুতের লোডশেডিং ও মূল্যস্ফীতিসহ নানা ইস্যুতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যখন নানা গুজব, গুঞ্জন ছড়াচ্ছে, সে সময় অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির একটি নির্দেশের পর তৈরি হয় নতুন চাপ।
১১ অক্টোবর বিএসইসি জানায়, চেক জমা দিয়েই শেয়ার কেনা যাবে না। চেক নগদায়ন হওয়ার পরই কিনতে হবে শেয়ার। এরপর থেকে লেনদেন ক্রমাগত কমতে থাকে। স্টক ব্রোকারদের সমিতির পক্ষ থেকে বিএসইসিকে জানানো হয়, এই নির্দেশনা না পাল্টালে বাজারে চাপ বাড়বে।
সত্য সত্য চাপ বাড়তে থাকে এরপর থেকে। ফ্লোর প্রাইসের মধ্যে যেসব কোম্পানির শেয়ারদর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল, দর হারাতে থাকে সেগুলোও। আর ফ্লোর প্রাইসের কিছু বেশি দর রয়েছে, এই কোম্পানিগুলো দর হারিয়ে ফ্লোরে নেমে আসতে থাকে।
তবে মঙ্গলবার থেকে এই কোম্পানিগুলো আবার উত্থানে ফিরতে শুরু করে। আর টানা তিন কর্মদিবসে হারানো দর কিছুটা ফিরেও পেয়েছে তারা। তবে শক্তিশালী মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর এখনও ফ্লোরেই অবস্থান করছে, যা পুঁজিবাজারের দুর্বলতার প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বৃহস্পতিবারও সেসব কোম্পানির শেয়ারদরই বেশি বেড়েছে, সেগুলোর দর বৃদ্ধি নিয়ে গত প্রায় তিন মাস ধরে নানা আলোচনা চলছ। বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারদরই গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে। তাদের শেয়ারপ্রতি আয়, লভ্যাংশ, শেয়ারপ্রতি সম্পদ, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা বা অন্য কোনো ইস্যু নেই, সেগুলো বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবে।
সিংহভাগ ক্ষেত্রেই এসব কোম্পানির শেয়ারসংখ্যা কম। আর এই বিষয়টি ব্যবহার করেই নানা সময় শেয়ারদর অস্বাভাবিক হারে বাড়তে দেখা যায়।
এদিনও মোট লেনদেনের ৬০ শতাংশ হয়েছে কেবল ২০টি কোম্পানিতে। সূচক যত পয়েন্ট বেড়েছে তার ৮০ শতাংশ বেড়েছে ১০টি কোম্পানির কারণে।
বৃহস্পতিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের চিত্র
মোট লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৯৪ কোটি ৯৮ লাখ ৫২ হাজার। এর আগে সবশেষ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল ১৯ অক্টোবর। সেদিন হাতবদল হয় ১ হাজার ১৭৮ কোটি ৭১ লাখ ২ হাজার টাকা।
এর মধ্যে সর্বাধিক লেনদেন হওয়া ২০টি কোম্পানিতেই হাতবদল হয়েছে ৬৬৭ কোটি ৭৮ লাভ ১৭ হাজা টাকা।
দর বেড়েছে এমন ৭৮টি কোম্পানিতে লেনদেন হয়েছে ৬০৮ কোটি ৩০ লাখ। দর কমেছে এমন কোম্পানিগুলোতে লেনদেন হয়েছে ৩৬৩ কোটি ২০ লাখ টাকা।
অন্যদিকে ফ্লোরে লেনদেন হওয়া দুই শতাধিক কোম্পানিতে হাতবদল হয়েছে কেবল ৩১ কোটি টাকা।
এদিন সবচেয়ে বেশি লেনদেন হওয়া সোনালী পেপারে হাতবদল হয়েছে ১২৬ কোটি ৪৬ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ ফ্লোরে থাকা কোম্পানিগুলোর মোট লেনদেনের চার গুণেরও বেশি লেনদেন হয়েছে স্বল্প মূলধনি সোনালী পেপারে, যেটিকে ২০০৯ সালে ওটিসি মার্কেটে পাঠানো হয়েছিল।
পুঁজিবাজারের লেনদেন নিয়ে ট্রেজার সিকিউরিটিজের শীর্ষ কর্মকর্তা মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আজকে ট্রানজেকশন মোটামুটি হয়েছে, তবে সিলেক্টিভ আইটেমের বাইরে বায় প্রেশার খুব বেশি দেখা যায়নি।
‘আইটি খাতে কয়েকটা কোম্পানি ও ওরিয়ন ফার্মা ভালো করেছে। গতকাল বেশ কিছু কোম্পানির পর্ষদ সভা ছিল, কিন্তু সেই হিসেবে ওই সব কোম্পানি খুব একটা পারফর্ম করতে পারেনি।’
ফ্লোর প্রাইসে থাকা কোম্পানিগুলোর লেনদেন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ফ্লোর প্রাইসের থাকা কোম্পানিগুলো ওই সার্কেল থেকে বের হতে পারছে না। ওই শেয়ার বিক্রি করতে না পারায় টাকা আটকে আছে। যার কারণে সেক্টরার মুভমেন্ট হচ্ছে না, এমনকি সেসবেও লেনদেন হচ্ছে না খুব একটা।’
কাগজ ও মুদ্রণ খাতের বড় লাফ
অবিশ্বাস্য উত্থান হয়েছে কাগজ ও মুদ্রণ খাতের। আগের দিন ৩০ কোটির নিচে লেনদেন হওয়া খাতটি বৃহস্পতিবার শীর্ষে উঠে এসেছে।
খাতের ৬টি কোম্পানিতে লেনদেন হয়েছে ২১৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা, যা মোট লেনদেনের ২১.৩৮ শতাংশ। বুধবার লেনদেন হয়েছিল ২৬ কোটি ৩৭ লাখ বা ২.৬৩ শতাংশ।
যে ছয়টি কোম্পানির লেনদেন হয়েছে তার মধ্যে দর বেড়েছে ৩টির, কমেছে ২টির ও একটির লেনদেন হয়েছে আগের দরে।
১৪৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা লেনদেন করে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বিবিধ খাত। আগের দিনে ১৩৪ কোটি ৫ লাখ টাকা বা ১৯.২৭ শতাংশ লেনদেন করে শীর্ষে ছিল খাতটি। খাতটিতে ৩টি কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে ৩টির লেনদেন হয়েছে অপরিবর্তিত দরে ও ৫টির দরপতনে।
এর পরেই ওষুধ ও রসায়ন খাতে লেনদেন হয়েছে ১৪১ কোটি ৮০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। আগের দিনে এর পরিমাণ ছিল ১০৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ৭টি কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে ১৩টির লেনদেন হয়েছে আগের দরে। দরপতন হয়েছে ১০টির।
চতুর্থ সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে প্রকৌশল খাত। ১১৯ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। বুধবার শতকোটির নিচে ছিল লেনদেন। ১০টি কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে ২২টির লেনদেন হয়েছে আগের দরে। দরপতন হয়েছে ৯টির।
আর কোনো খাতের লেনদেন শত কোটির ঘর অতিক্রম করেনি।
৬৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা লেনদেন করে পঞ্চম স্থানে থাকা প্রযুক্তি খাতের ৪টির দরবৃদ্ধির বিপরীতে আগের দরে লেনদেন হয়েছে ২টি কোম্পানির। ৪টি কোম্পানির দরপতন হয়েছে।
জ্বালানি খাতে ৫৮ কোটি ৩০ লাখ এবং ভ্রমণ ও অবকাশ খাতে ৫২ কোটি ২০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। বাকি খাতের লেনদেন পঞ্চাশ কোটির নিচে ছিল।
আগের দিনের মতোই সাধারণ বিমা, বস্ত্র, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিপুল সংখ্যক শেয়ার লেনদেন হয়েছে অপরিবর্তিত দরে, যার প্রায় সবই ফ্লোর প্রাইসে। আগের দিনের চেয়ে ৩টি কমে ২৩টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের লেনদেন হয়েছে ফ্লোর প্রাইসেই।
সূচকে প্রভাব যাদের
১০ দশমিক ৮০ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে বিকন ফার্মা। এদিন শেয়ারটির দর বেড়েছে ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ।
সোনালী পেপারের দর ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে ৩ দশমিক ৫৩ পয়েন্ট।
ওরিয়ন ফার্মা সূচকে যোগ করেছে ৩ দশমিক ২৬ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
এর বাইরে সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে ইউনিক হোটেল, বসুন্ধরা পেপার, শাহজিবাজার পাওয়ার, ইউনাইটেড পাওয়ার, নাভানা ফার্মা, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ ও লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৮২ পয়েন্ট।
বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ১ দশমিক ২৬ পয়েন্ট সূচক কমেছে বেক্সিমকো ফার্মার দরপতনে। কোম্পানিটির দর কমেছে ১ দশমিক ০১ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১ দশমিক ০১ পয়েন্ট কমেছে তমিজউদ্দিন টেক্সটাইলের কারণে। শেয়ার প্রতি দাম কমেছে ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
এসিআই ফর্মূলেশনের শেয়ারদর ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে শূন্য দশমিক ৭৭ পয়েন্ট।
এ ছাড়াও আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, ইস্টার্ন ক্যাবলস, বার্জার পেইন্টস, আল-আরব ব্যাংক, ইস্টার্ন হাউজিং, জেএমআই সিরিঞ্জেস ও বিডি ল্যাম্পসের দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ৫ দশমিক ৮৪ পয়েন্ট।
দরবৃদ্ধির শীর্ষ ১০
১০ শতাংশ নগদ বা শেয়ার প্রতি ১ টাকা এবং ১:২ অনুপাতে বা বিদ্যমান ২টি শেয়ারের বিপরীতে একটি রাইট শেয়ার ইস্যু করার ঘোষণার পর সিনোবাংলার দর বেড়েছে ২৯.৯০ শতাংশ বা ১৮ টাকা। কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৭৮ টাকা ২০ পয়সায়। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৬০ টাকা ২০ পয়সায়।
এর পরেই ১০.৯৩ শতাংশ দর বেড়েছে আফতাব অটোসের। ৫ শতাংশ করে নগদ ও বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণার পরে কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়ে লেনদেন হয়েছে ২৮ টাকা ২০ পয়সায়। আগের দিনে দর ছিল ২৫ টাকা ৬০ পয়সা।
সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের দর ৯.৯৪ শতাংশ বেড়ে ৫৮ টাকা ৬০ পয়সায় শেয়ার লেনদেন হয়েছে। গতকাল এটি ৫৩ টাকা ৩০ পয়সায় লেনদেন হয়েছিল।
শীর্ষ দশের মধ্যে বসুন্ধরা পেপার, নাভানা ফার্মা ও নাভানা সিএনজির দর বেড়েছে ৯ শতাংশের ওপরে। ইনফরমেশন সার্ভিসেস ও বিকন ফার্মার দর বেড়েছে ৮ শতাংশের বেশি। আর ইউনিক হোটেল ও ইনডেক্স অ্যাগ্রোর দর বেড়েছে ৭ শতাংশের ওপরে।
দর পতনের শীর্ষ ১০
এই তালিকার শীর্ষে ছিল তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল। ৮.৩৮ শতাংশ দর কমে প্রতিটি শেয়ার সর্বশেষ ২০৭ টাকা ৬০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। আগের দিনে লেনদেন হয় ২২৬ টাকা ৬০ পয়সায়।
পরের স্থানে ছিল অ্যারামিট ইন্ডাস্ট্রিজ। ৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ দর কমে শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৩১৯ টাকা ৯০ পয়সায়। আগের দিনের ক্লোজিং প্রাইস ছিল ৩৪২ টাকা ৪০ পয়সা।
তৃতীয় সর্বোচ্চ দর হারিয়েছে বিডি ল্যাম্পস। ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ কমে শেয়ারটি সর্বশেষ ২৭৪ টাকা ৩০ পয়সায় হাতবদল হয়। আগের দিনে লেনদেন হয়েছিল ২৯৩ টাকা ৪০ পয়সায়।
দর কমার শীর্ষ দশে থাকা অন্য কোম্পানিগুলো ছিল- অ্যাপেক্স ফুডস, এসিআই ফর্মুলেশনস, জেমিনি সি-ফুড, ইস্টার্ন ক্যাবলস, সোনালী আঁশ, বিডি ওয়েল্ডিং ও পেপার প্রসেসিং।