বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক ঘুমিয়ে আছে বলে মন্তব্য করেছে উচ্চ আদালত।
বিদেশে পাচার করা টাকা ফেরত আনতে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংস্থাটির আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) তিন মাস সময় দিয়ে এই মন্তব্য করে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ।
বুধবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ বুধবার এ আদেশ দেয়। এ সময় নজরুল ইসলাম তালুকদার দুদক নিয়ে এই মন্তব্য করেন।
অর্থ পাচার নিয়ে বিএফআইইউর জমা দেয়া প্রতিবেদন আমলে নিয়ে এই আদেশ দেয়া হয়।
প্রতিবেদনটি আদালতে জমা দেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। এ সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে খুরশীদ আলম খান আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
চুক্তি করতে তিন মাস সময়
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, ‘আদালত প্রতিবেদনটি দেখে পাচারকৃত টাকা ফেরত আনতে সরকার টু সরকার চুক্তি করতে নির্দেশ দিয়েছে। এটি বিএফআইইউর প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল না। এ কারণে নির্দেশ দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘পরবর্তী প্রতিবেদন দিতে আমরা আদালতের কাছে তিন মাসের সময় চেয়েছিলাম। আদালত সময় দিয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছে।’
দেশের বাইরে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে কমপক্ষে ১০টি দেশের সঙ্গে পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তি (এমএলএ) করা দরকার বলে উল্লেখ করে মঙ্গলবার হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দেয় বিএফআইইউ।
এই ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, চায়না বিশেষ করে হংকং।
টাকা ফেরত আনতে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাক্ষ্যপ্রমাণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণের জন্য এটি করা প্রয়োজন উল্লেখ করে তার যৌক্তিকতা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে অবহিত করেছে বলেও জানানো হয়েছে।
বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা জানতে গত ১১ আগস্ট আদেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট।
সুইস ব্যাংকের কাছ থেকে তথ্য পেতে সরকার সঠিক চ্যানেলে যোগাযোগ করেনি বলে ঢাকায় সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতের এক বক্তব্য পত্রিকায় প্রকাশিত হলে আদালত সেটি আমলে নিয়ে এই প্রতিবেদন চায়।
এরপর আদালতে দুদক এবং বিএফআইইউর পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ হলফনামা আকারে তথ্য জমা দেয়। ওই হলফনামায় যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করায় বিএফআইইউ প্রধানকে তলব করা হয়।
সেই তলবে ৩১ আগস্ট হাজির হয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করায় বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস ক্ষমা চান। পরে আদালত তাকে সতর্ক করে দেন।
সেই আদেশ অনুসারে বিএফআইইউ ফের প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে বলা হয়, বিদেশে অর্থ পাচারে জড়িতদের চিহ্নিত করা ও পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার জন্য প্রস্তাবিত রিসার্চ সেলে লোকবল পদায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করা হয়েছে। এটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
অর্থ ফেরত আনার কার্যক্রম সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, পাচার করা অর্থ ফেরত আনা সম্পর্কিত মামলায় তথ্য-প্রমাণ বিদেশি রাষ্ট্র থেকে যথাসময়ে না পাওয়ার প্রেক্ষাপটে অ্যাটর্নি জেনারেলের নেতৃত্বে বিদেশে পাচার করা সম্পদ ফেরত আনার বিষয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের ষষ্ঠ সভা হয় গত ৩ জানুয়ারি।
সভায় পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাক্ষ্যপ্রমাণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তা গ্রহণের জন্য ৬-৭টি দেশের সঙ্গে পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তি (এমএলএ চুক্তি) করার বিষয়টি পর্যালোচনার লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, বিএফআইইউ ও বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের অংশগ্রহণে সভা আয়োজন করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এ সিদ্ধান্তের সূত্রে বিএফআইইউ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়কে সভা আয়োজনের অনুরোধ করে। পরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কোন কোন দেশের সঙ্গে এ পর্যায়ে এমএলএ চুক্তি করতে হবে এবং এর যৌক্তিকতা জানানোর জন্য বিএফআইইউকে অনুরোধ করে। তখন বিএফআইইউ ১০টি দেশের সঙ্গে এমএলএ চুক্তির যৌক্তিকতা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে অবহিত করে।
অর্থ পাচার নিয়ে ভারতীয় আদালতের রায় সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির সুপ্রিম কোর্টের ‘রামজিৎ মালানি বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড আদার্স’ শীর্ষক মামলার রায় সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করা হয়েছে।
ভারতের নেয়া ব্যবস্থার অনুরূপ ব্যবস্থা বাংলাদেশেও আইনানুগভাবে গ্রহণ করা যায় কি না তা পর্যালোচনার সুপারিশ সুইস ব্যাংকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হতে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে প্রস্তুতকৃত কৌশলপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সুইস ব্যাংকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হতে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে প্রস্তুতকৃত কৌশলপত্র/প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির ৩০ আগস্টের ২৬তম সভার আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটি জাতীয় সমন্বয় কমিটির পরবর্তী সভায় আলোচনা ও অনুমোদন পাবে আশা করছে বিএফআইইউ।