দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জে ফ্লোর প্রাইস কার্যকরের পর থেকে অস্বাভাবিকভাবে যেসব স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছিল, গত তিন-চার দিন সেসবের ওপর ‘ঝড়’ বয়ে যাওয়ার পর আবারও উত্থান দেখা গেল। এর প্রভাবে সূচক বাড়লেও লেনদেনে ফেরেনি গতি।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসইতে বেশ কয়েক দিন পর দরপতনের তুলনায় চার গুণ দরবৃদ্ধি দেখা গেল, তবে বিপুলসংখ্যক শেয়ার এখনও ফ্লোর প্রাইসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
২১টি কোম্পানির দরপতনের বিপরীতে দর বেড়েছে ৮৬টির। আর আগের দরে লেনদেন হয়েছে ২৪৮টির, যার দুই-একটি বাদে সবগুলোই রয়েছে ফ্লোর প্রাইসে।
মঙ্গলবার যতগুলো কোম্পানির দর বেড়েছে তার সিংহভাগই স্বল্প মূলধনি। শীর্ষ দশের মধ্যে ৬টিই এমন কোম্পানি। আর ২টি মাঝারি মূলধনের কোম্পানির সংখ্যা গণনায় নিলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৮টিতে।
আর ৩ শতাংশের ওপর দর বেড়েছে এমন ৪২টি কোম্পানির মধ্যে ৩৫টিই ছিল স্বল্প মূলধনি, যার কয়েকটি মাঝারি মূলধনের হলেও, তা শতকোটির নিচে।
আগের সপ্তাহে চার কর্মদিবস টানা সূচক পতনের পরে বৃহস্পতিবার ২ পয়েন্ট লেনদেন শেষ হয়েছিল। চলতি সপ্তাহের প্রথম দুই কর্মদিবস সূচক পড়ে ৮৩ পয়েন্ট।
তবে সোমবার যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যে ১ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট লেনদেন হয়েছে, তাতে ৩৬ পয়েন্ট পতন হয়েছে। পুরো সময় লেনদেন হলেও পতন আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
গতকাল যথারীতি সকাল সাড়ে ৯টায় লেনদেন শুরুর পর ১০টা ৫৮ মিনিটে এসে হঠাৎ করেই লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। লেনদেনের নির্ধারিত সময় ১টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত লেনদেন শুরুই করা যায়নি। পরে ২টা ১০ থেকে আড়াইটা পর্যন্ত চলে লেনদেন।
তবে এদিন চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন স্বাভাবিক ছিল এবং সূচক কমেছে ০.৭৭ শতাংশ বা ১০ পয়েন্ট। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জেও যদি শতকরা হিসেবে একই হারে পতন হতো, তাহলে সূচক পড়তে পারত ৪৮ পয়েন্ট।
চেক নগদায়নের আগপর্যন্ত শেয়ার কেনা যাবে না, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এই নির্দেশনা দেয়ার পর গতকাল পর্যন্ত আট কর্মদিবসেই সূচক পড়েছে ১৯২ পয়েন্ট।
মঙ্গলবার সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সূচক বেড়েছে ২০ পয়েন্ট। যদিও দিনের মধ্যভাগে আরও বেশি সূচক বেড়ে লেনদেন হতে দেখা গেছে।
লেনদেন শুরুর ৪০ মিনিটেই আগের দিনে যতটুকু সূচক কমেছিল, তা ততটুকু বেড়ে যায়। এরপরে দ্রুতই পতন হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই আবার ঘুরে দাঁড়ায়। উত্থান-পতনের মধ্যে বেলা ১১টা ১৯ থেকে ২১ মিনিট পর্যন্ত সূচক দিনের সর্বোচ্চ অবস্থানে ছিল। ৪৯ পয়েন্ট বেড়ে সূচকের অবস্থান দাঁড়ায় ৬ হাজার ৩৫৬ পয়েন্টে।
এর পরে দরপতনে সূচক কমেছে ধারাবাহিকভাবে। শেষ মুহূর্তের সমন্বয়ে ২০ পয়েন্ট বেড়ে সূচক দাঁড়ায় ৬ হাজার ৩২৮ পয়েন্টে।
১১ অক্টোবর স্টক ব্রোকারদের উদ্দেশে জারি করা বিএসইসির এক নির্দেশনায় বলা হয়, চেকের টাকা নগদায়নের আগে তা দিয়ে শেয়ার কেনা যাবে না।
এই নির্দেশনার পরই পুঁজিবাজারে লেনদেন কমতে দেখা গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। একসময় যে লেনদেন ২ হাজার কোটির ঘরে ও এর কাছাকাছি হতো, সেটি চলে আসে হাজার কোটির ঘরে।
চেক নগদায়নের এ সিদ্ধান্ত না পাল্টালে পুঁজিবাজারে চাপ আরও বাড়বে বলে স্টক ব্রোকাররা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিকে চিঠি দেয়। গত সোমবার বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রচারের পরদিনই পুঁজিবাজারে চাপ বাড়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রতিদিনই কমতে থাকে লেনদেন। গতকালের লেনদেন বাদ দিলে আজ লেনদেন হয়েছে ৫০ কর্মদিবসের মধ্যে সর্বনিম্ন। দিনভর হাতবদল হয়েছে ৬২৩ কোটি ৫০ লাখ ৫৪ হাজার টাকার শেয়ার, মিউচ্যুয়াল ফান্ড ও বন্ড।
এর আগে এর চেয়ে কম লেনদেন হয়েছিল গত ১১ আগস্টে। ওই দিন ডিএসইতে লেনদেন হয় ৫৮৩ কোটি ৭৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকা।
কার কেমন দরবৃদ্ধি
দরবৃদ্ধির শীর্ষ দশের পঞ্চম ও ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে বসুন্ধরা পেপার ও নাভানা ফার্মা। কোম্পানি দুটির দর বেড়েছে ৯.৯২ ও ৯.৮৭ শতাংশ। আর মাঝারি মূলধনের বিডিকম ও এডিএন টেলিকম ছাড়া বাকি সব স্বল্পমূলধনি।
আগের দিন ৮.৪৩ শতাংশ দরপতনের পরে আজ সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে স্বল্পমূলধনি তমিজউদ্দিন টেক্সটাইলের। ৯.৯৯ শতাংশ দর বেড়ে শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২১০ টাকা ৩০ পয়সা।
ফ্লোর প্রাইস কার্যকরের দিন কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ১৭৮ টাকা ৪০ পয়সা। গত ১৬ অক্টোবর দর ছিল ২৬৭ টাকা ৩০ পয়সা। সেখান থেকে ৭৬ টাকা ১০ পয়সা কমে গিয়ে গতকাল লেনদেন হয় ১৯১ টাকা ২০ পয়সায়।
জুট স্পিনার্সের দর ৯.৯৮ শতাংশ কমে ১৯৩ টাকা ১০ পয়সায় শেয়ার লেনদেন হয়েছে। ১৬ অক্টোবর এটি লেনদেন হয়েছিল ২২১ টাকায়। সাত কর্মদিবসে ৪৪ টাকার মতো কমে গতকাল এটি ১৭৬ টাকা ২০ পয়সায় লেনদেন হয়েছিল।
৯.৯৩ শতাংশ দর বেড়েছে এডিএন টেলিকমের। আগের দিন ১০২ টাকা ৭০ পয়সায় লেনদেনের পরে আজ প্রতিটি শেয়ার হাতবদল হয়েছে ১১২ টাকা ৯০ পয়সায়।
চতুর্থ সর্বোচ্চ ৯.৯২ শতাংশ দর বেড়েছে ৫৭ কোটি মূলধনের কোম্পানি বিডিকমের। শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৪৬ টাকা ৫০ পয়সায়। আগের দিনে এর দর ছিল ৪২ টাকা ৩০ পয়সা।
ই-জেনারেশনের দর বেড়েছে ৯.৮৫ শতাংশ। ৪৬ টাকা ৭০ পয়সায় লেনদেন হওয়া শেয়ারটি হাতবদল হয়েছে ৫১ টাকা ৩০ পয়সায়।
ইয়াকিন পলিমারের দর ৯.৮৪ শতাংশ বেড়ে শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২১ টাকা ২০ পয়সায়। আগের দিনের ক্লোজিং প্রাইস ছিল ১৯ টাকা ৩০ পয়সা।
শমরিতা হসপিটালের দর বেড়েছে ৯.৬৫ শতাংশ। ৭২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বেড়ে ৭৯ টাকা ১০ পয়সায় শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
রংপুর ফাউন্ড্রির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২০৯ টাকা ৪০ পয়সায়। দর বেড়েছে ৮.৯৪ শতাংশ।
এ ছাড়া ৮ শতাংশের ওপর দর বেড়েছে মনোস্পুল, অ্যারামিট, প্রাণ, পেপার প্রসেসিং, জেমিনি সি-ফুড, সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্স, আমরা টেকনোলজিস ও বিডি ল্যাম্পসের।
৭ শতাংশের বেশি দর বেড়েছে আরও ৫টির, ৪টির দর বেড়েছে ৬ শতাংশের বেশি। ১৩টির দর বেড়েছে ৩ থেকে ৬ শতাংশের নিচে।
‘পুঁজিবাজারে টাকা আসছে না’
পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে ক্যাল সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রাজেশ সাহা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বছরের দুই-তিন মাস ভালো থাকে। মানি মার্কেট খারাপ, যদি ব্যাংকগুলোর হাতে টাকা থাকতো তখন ব্যাংকগুলোর ইনভেস্টমেন্ট এদিকে আসতো। আবার মানুষের হাতের টাকাও পুঁজিবাজারে আসতো, কিন্তু এখন তো কারও হাতেই টাকা নেই। যার প্রভাব পুঁজিবাজারে দেখা যাচ্ছে।’
স্বল্পমূলধনির দরবৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মার্জিনেবল শেয়ার বা বড়গুলো যখন পারফর্ম করতে পারে না, সেগুলোতে যখন ভালো রিটার্ন পাচ্ছে না তখন মানুষ এদিকে ঝুঁকে পড়েন।
‘বড়গুলো যখন ভালো পারফর্ম করে না, তখন দেখা গেল কারও লোন কোড আছে, লোন অ্যাডজাস্ট করল এক কোটি টাকা। এরপর তার হাতে যে টাকা থাকল সেটা তখন এ দিকে চলে আসে। এ সংখ্যাটা এভাবে বেড়ে যায়।’
সূচকে প্রভাব যাদের
১ দশমিক ৯৭ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে ইউনিক হোটেল। এদিন শেয়ারটির দর বেড়েছে ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
বসুন্ধরা পেপারের দর ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে ১ দশমিক ৯৬ পয়েন্ট।
এডিএন টেলিকম সূচকে যোগ করেছে ১ দশমিক ০৮ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
এর বাইরে সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে তমিজউদ্দিন টেক্সটাইল, ইস্টার্ন হাউজিং, আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, পূবালী ব্যাংক, ওরিয়ন ইনফিউশন, বিএসআরএম স্টিল ও নাভানা ফার্মা।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ১০ দশমিক ৬২ পয়েন্ট।
বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ২ দশমিক ১৫ পয়েন্ট সূচক কমেছে বেক্সিমকো লিমিটেডের দরপতনে। কোম্পানিটির দর কমেছে ১ দশমিক ২৬ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৪৯ পয়েন্ট কমেছে বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক বন্ডের কারণে। শেয়ার প্রতি দাম কমেছে শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশ।
অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের দর ১ দশমিক ০৪ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে শূন্য দশমিক ৩৯ পয়েন্ট।
এ ছাড়াও অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, সাউথ ইস্ট ব্যাংক, সোনালী পেপার, এনসিসি ব্যাংক, নাভানা সিএনজি ও বিকন ফার্মার দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ৪ দশমিক ৪৪ পয়েন্ট।
কোন খাত কেমন
১১১ কোটি ৯ লাখ টাকা লেনদেন করে শীর্ষে উঠে এসেছে আগের দিনে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বিবিধ খাত। খাতটিতে ৪টি কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে ৭টির লেনদেন হয়েছে অপরিবর্তিত দরে ও ২টির দরপতনে।
ওষুধ ও রসায়ন খাতে লেনদেন হয়েছে ১০০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ১৫টি কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে ১৪টির লেনদেন হয়েছে আগের দরে। দরপতন হয়েছে ১টির।
তৃতীয় স্থানে রয়েছে প্রকৌশল খাত। ৮৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। ১৪টি কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে ২৬টির লেনদেন হয়েছে আগের দরে। দরপতন হয়েছে ২টির।
এরপরেই প্রযুক্তি খাতে লেনদেন হয়েছে ৫০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ৭টির দরবৃদ্ধির বিপরীতে আগের দরে লেনদেন হয়েছে ৩টি কোম্পানির।
৪৩ কোটি টাকা লেনদেন করে তালিকার পঞ্চম স্থানে ছিল জ্বালানি খাত। ১৭টি কোম্পানির আগের দরে লেনদেন হয়েছে। ২টির দরপতন হয়েছে ও ৪টির দরবৃদ্ধি হয়েছে।
এ ছাড়া কাগজ ও মুদ্রণ খাতে ৩৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ও খাদ্য খাতে ৩০ কোটি বা ৫.০৯ শতাংশ লেনদেন হয়েছে। আর কোনো খাতের লেনদেন পাঁচ শতাংশ ছাড়ায়নি।
দর পতনের শীর্ষ ১০
পতনের তালিকার শীর্ষে রয়েছে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার। ৬.৯১ শতাংশ দর কমে প্রতিটি শেয়ার সর্বশেষ ২৬৩ টাকা ৭০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে। আগের দিনে লেনদেন হয় ২৮৩ টাকা ৩০ পয়সায়।
পতনের তালিকায় পরের স্থানে রয়েছে নাভানা সিএনজি। ৩ দশমিক ২৭ শতাংশ দর কমে শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২৬ টাকা ৬০ পয়সায়। আগের দিনের ক্লোজিং প্রাইস ছিল ২৭ টাকা ৫০ পয়সা।
তৃতীয় সর্বোচ্চ দর হারিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানি। ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ কমে শেয়ারটি সর্বশেষ ৫ টাকা ৬০ পয়সায় হাতবদল হয়। আগের দিনে লেনদেন হয়েছিল ৫ টাকা ৭০ পয়সায়।
দর কমার শীর্ষ দশে থাকা অন্য কোম্পানিগুলো ছিল- বেক্সিমকো লিমিটেড, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টস, আফতাব অটোস ও এনসিসি ব্যাংক।