বন্দরে জাহাজ ভেড়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য খালাসের লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ‘অথোরাইজড ইকোনমিক অপারেটর’ বা এইও ব্যবস্থা চালু করে ২০১৯ সালে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি বাড়াতে তিন বছর আগে এই বিশেষ ব্যবস্থা চালু হলেও এতে তেমন সাড়া মিলছে না।
এই ব্যবস্থার আওতায় প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো বাধাবিপত্তি ছাড়াই আমদানি করা পণ্য বন্দর থেকে খালাস করে নিজের কারখানায় নিয়ে যেতে পারে। এটা অনেকটা বিমানবন্দরের গ্রিন চ্যানেলের মতো। কাস্টমসের ঝামেলা পোহাতে হয় না। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্দরে দ্রুত কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সুবিধা পেয়ে থাকে। এতে পণ্য খালাসে সময় ও খরচ বাঁচে, যা ব্যবসা-বাণিজ্যের গতিকে ত্বরান্বিত করে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ এ সুবিধার আওতায় এ পর্যন্ত দেশের তিনটি প্রতিষ্ঠানকে অথোরাইজড ইকোনমিক অপারেটরের মর্যাদা দেয়া হয়। এগুলো হচ্ছে : বেক্সিমকো, স্কয়ার ও ইনসেপটা।
এ ব্যবস্থা পরীক্ষামূলক চালু হওয়ার সময় এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এক মাসের মধ্যে টেক্সটাইল, ওষুধ ও চামড়া খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে আরও ১০টি প্রতিষ্ঠানকে ‘এইও’ সনদ দেয়ার জন্য বাছাই করা হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে এই সুবিধা দেয়া হয়নি।
বন্দর আমদানি করা পণ্য দ্রুত খালাসের লক্ষ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে অথোরাইজড ইকোনমিক অপারেটরের মর্যাদা দেয়া হয়। এগুলো হচ্ছে বেক্সিমকো, স্কয়ার ও ইনসেপটা। ছবি: নিউজবাংলা
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এনবিআর প্রক্রিয়াটি আরও উন্নত ও জনপ্রিয় করতে না পারায় অথোরাইজড ইকোনমিক অপারেটর উদ্যোগে ভাটা পড়ে। তা ছাড়া কাস্টমস কর্মকর্তাদের মনোভাব পরির্বতন করা দরকার।
এদিকে, সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কথা ছিল প্রতিষ্ঠান তিনটি চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস ও ঢাকা কাস্টম হাউসে দ্রুত ক্লিয়ারেন্স পাবে। কিন্তু এই মর্যাদা পাওয়ার পরও কোনো হেরফের হয়নি। কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সে এখনও আগের মতোই তিন থেকে চারদিন সময় লাগছে। এ জন্য কাস্টমসের আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে দায়ী করেন তারা।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, সনদপ্রাপ্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলেও তারা তা করছেন না। যে কারণে ‘এইও’ সুবিধা পাচ্ছে না কোম্পানিগুলো।
এনবিআরের শুল্ক মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেট ‘এইও’ সনদ দেওয়ার জন্য ৬৩টি প্রতিষ্ঠানের আবেদন যাচাই-বাছাই করছে বলে জানিয়েছেন এটির কমিশনার মোহাম্মদ এনামুল হক।
তিনি আরও জানান, চলতি বছরের এপ্রিলে আরও কিছু নতুন প্রতিষ্ঠানকে ‘এইও’ সুবিধা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। তবে শর্ত পূরণ না হওয়ায় এখনও কোনো প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন করা হয়নি। আশা করা যাচ্ছে ১০ থেকে ১৫টি কোম্পানি শর্ত পূরণ করতে পারবে এবং সনদ দেয়া হবে।
জানা গেছে, ৬৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কমপক্ষে ১২টি টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক আমদানি-রপ্তানি খাতের সঙ্গে যুক্ত। এর বাইরে আবুল খায়ের গ্রুপের ১০টি, বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের (বিএসআরএম) তিনটি; বেক্সিমকো, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, শাহ সিমেন্ট লিমিটেড, এসকায়েফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেড, সিনজেন্টা বাংলাদেশ লিমিটেড ও ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের দুটি কোম্পানি এইও সুবিধার জন্য আবেদন করেছে।
বিশ্ব শুল্ক সংস্থা (ডব্লিউওসি) ২০০৫ সালে পণ্যের নির্বিঘ্ন চলাচলের জন্য ‘এইও’ কর্মসূচি চালু করে। কাস্টমসের আনুষ্ঠানিকতা সহজ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ২০১৭ সালে বিদ্যমান শুল্ক আইন সংশোধন করে।
২০১৮ সালে এনবিআর এইও সুবিধা পাওয়ার মানদণ্ড উল্লেখ করে একটি আদেশ জারি করে। পরের বছর ওষুধ খাতের তিনটি প্রতিষ্ঠানকে এই সুবিধা দেয়া হয়।
জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো এইও সুবিধা নিয়ে অনেক এগিয়ে গেছে।
ডব্লিউসিওর তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে এইও সনদ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১১ হাজার ২০টি, ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ১৭ হাজার ৮৯৫টি, চীনে ৩ হাজার ২০৩টি, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৮৪৫টি এবং জাপানে ৭০৬টি।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ২০২০ সালের ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ প্রতিবেদনে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৮তম। কাস্টমস ও বন্দরে দক্ষতার অভাব বাংলাদেশের এই পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ।
এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের লজিস্টিক পারফরম্যান্স ইনডেক্স (এলপিআই) অনুযায়ী, চীন, ভিয়েতনাম, ভারত ও কম্বোডিয়াসহ প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এই সূচকেও বাংলাদেশ কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সে সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স করেছিল।
গত সেপ্টেম্বরে এনবিআর প্রকাশিত টাইম রিলিজ স্টাডির (টিআরএস) তথ্য অনুযায়ী, বন্দরে জাহাজ ভেড়ার পর চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস থেকে পণ্যের চালান খালাস করতে গড়ে ১১ দিন ৬ ঘণ্টা লাগে। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের মাধ্যমেই দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। সর্বশেষ ২০১৪ সালে প্রকাশিত টিআরএসের তথ্য বিবেচনায়, পণ্য খালাসে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শীর্ষ কাস্টমস কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শুল্ক কর্মকর্তারা এইওতে অভ্যস্ত ছিলেন না। এ ছাড়া এনবিআরের আদেশেও কিছু অস্পষ্টতা ছিল। তবে এনবিআর এখন এ ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করে তুলতে কাজ করছে।’
মেট্রোপলিটন চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এটি কার্যকর করার জন্য কাস্টমস কর্মকর্তাদের এইও মর্যাদা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থা রাখতে হবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আরও বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে এইও সনদ দেয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, ‘এই উদ্যোগ সফল হলে এটি বন্দরে জট কমানোর পাশাপাশি ব্যবসায় সময় ও খরচ কমাতে সাহায্য করবে।’
এনবিআর সূত্র বলেছে,কয়েকটি নির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে এইও সুবিধা দেয়া হয়। সেসবের মধ্যে রয়েছে কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর আইনের আওতায় সন্তোষজনক কমপ্লায়েন্স রেকর্ড থাকতে হবে; আবেদনকারীকে আগের তিন বছর অপরাধমুক্ত থাকতে হবে; কোনো রাজস্ব বকেয়া থাকা যাবে না, যেকোনো মামলায় জরিমানার পরিমাণ মোট পণ্য বা সেবামূল্যের ১ শতাংশের বেশি হওয়া যাবে না।
এছাড়া আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত মূলধন কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকা ও পরিশোধিত মূলধন অন্তত ৫ কোটি টাকা হতে হবে। আর বার্ষিক আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ ন্যূনতম ৫ কোটি টাকা হতে হবে।