বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মূল্যছাড়ের নামে চালাকি

  •    
  • ২৪ অক্টোবর, ২০২২ ০৮:৩০

৫০ বা ৭০ বা তার চেয়ে বেশি ছাড়ের কথা বলে প্রচার চালালেও দেখা যায় ১০ থেকে ২০, কখনও ৩০ পর্যন্ত ছাড় দেয়া আছে। আবার এক-দুটি পণ্যে বড় যে ছাড় দেয়া হয়, সেগুলো আসলে কেউ কেনে না। হয় মানহীন নয় নষ্ট পণ্য, যেগুলো আসলে বিক্রি করারই কথা নয়। এসব পণ্যে খুঁত থাকলে আউটলেটে না দেখে বাড়িতে নিয়ে গেলে পরে পাল্টেও দেয়া হয় না।

বেশ কিছুদিন ধরে অথবা ডটকমের মূল্যছাড়ের বিজ্ঞাপন ফেসবুকে ঘুরছে। এর মধ্যে বাচ্চাদের খেলনার আইটেমের যে বিজ্ঞাপন, তাতে ভোক্তাকে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে ৭২ শতাংশ মূল্যছাড়ের কথা বলে। কিন্তু লিংকে ক্লিক করে ৭২ শতাংশ মূল্যছাড়ের একটি আইটেমও খুঁজে পাওয়া যায় না।

যেসব আইটেমে মূল্যছাড় আছে, তার বেশির ভাগ ১৫ শতাংশ, এক-দুটি ২০ শতাংশ, সর্বোচ্চ ৩৭ শতাংশ ছাড় পাওয়া একটি আইটেম পাওয়া যায়, যেটি ছিল একটি প্লাস্টিকের বল।

একজন ভোক্তা সেই বিজ্ঞাপনের কমেন্ট বক্সে ৭২ শতাংশ ছাড় না দিয়েও এভাবে প্রলুব্ধ করার কারণ জানতে চাইলে অথবার পক্ষ থেকে লেখা হয়, একটি আইটেমে এই ছাড় ছিল, কিন্তু সেটি শেষ হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে কথা বলতে অথবা ডটকমের অফিশিয়াল হেল্পলাইন নম্বরে ফোন দিলে ৩ মিনিট ১৪ সেকেন্ড অপেক্ষা করিয়ে রাখার পরও কেউ সাড়া দেননি।

দেশের বড় একটি কোম্পানি প্রাণ আরএফএলের জুতার ব্র্যান্ড ‘ওয়াকার ফুটওয়্যার’ও একই ধরনের বিজ্ঞাপন দিয়েছে।

তারাও ৫০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য ছাড়ের কথা বলে প্রলুব্ধ করতে চাইছে, কিন্তু আসলে ৫০ শতাংশ ছাড় আছে এমন জুতা খুঁজেই পাওয়া যায় না।

যোগাযোগ করা হলে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের কাস্টমস কেয়ার থেকে ওয়ালিদ নামের একজন প্রতিনিধি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা হচ্ছে আপ টু (পর্যন্ত) বিজ্ঞাপন। এখানে দেখুন স্যার ছোট করে ৫০ শতাংশ এর ওপরে আপ টু লেখা আছে। এখানে ২ শতাংশও হতে পারে, ৫ শতাংশও হতে পারে। কিন্তু সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। এটা ওয়ান কাইন্ড অব লটারি। যার ভাগ্যে যত আসে। তবে যদি কেউ ২ শতাংশ দেখে অর্ডার ক্যান্সেল করতে চায় সেই সুযোগও আছে।’

৫০ বা ৭০ বা তার চেয়ে বেশি ছাড়ের কথা বলে প্রচার চালালেও দেখা যায় ১০ থেকে ২০, কখনও ৩০ পর্যন্ত ছাড় দেয়া আছে। আবার এক দুটি পণ্যে বড় যে ছাড় দেয়া হয়, সেগুলো আসলে কেউ কেনে না। হয় মানহীন নয় নষ্ট পণ্য, যেগুলো আসলে বিক্রি করারই কথা নয়। এসব পণ্যে খুঁত থাকলে আউটলেটে না দেখে বাড়িতে নিয়ে গেলে পরে পাল্টেও দেয়া হয় না।

বিপুলসংখ্যক ক্রেতা এসব বিজ্ঞাপনের নিচে কমেন্ট বক্সে তাদের এই বিরূপ অভিজ্ঞতার কথা লিখে রাগ ঝাড়ছেন।

ছাড়ের বিজ্ঞাপনে ছোট করে পর্যন্ত বা শর্ত প্রযোজ্য বলে লিখে দিয়ে এখানে আকৃষ্ট করার প্রক্রিয়া যে ভোক্তাদের ইদানীং বিরক্ত করছে তা সামাজিক মাধ্যমে গেলেও বোঝা যায়।

কারণ জানতে চাইলে একরাম হোসেন নামে একজন ক্রেতা বলেন, ’৫০ শতাংশ ছাড় দেখে দোকানে ঢুকে দেখবেন, নষ্ট বা একেবারেই মানহীন পণ্যে এই ছাড় দিয়ে রেখেছে। আপনার যেটি পছন্দ হবে, সেটিতে দেখবেন ছাড় নেই বা ৫ থেকে ১০ বা ১৫ শতাংশ।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান মনে করেন, ভোক্তাকে এভাবে প্রলোভন দেখানো কখনই গুড মার্কেটিং প্র্যাকটিসের কাতারে পড়ে না। এটা করা অবশ্যই অন্যায়।

তিনি বলেন, অন্যান্য দেশে ছাড়ের নামে এভাবে চাতুরি এই যুগে আর নেই। তিনি মনে করেন, যতটুকু ছাড় দেবে, ততটুকু নির্দিষ্ট করে লেখা থাকলেই ভোক্তা আকৃষ্ট হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দিয়ে এই বিপণন বিশেষজ্ঞ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায়ই দেখা যায়, কোনো কোম্পাানি কিছু পণ্যে বড় ছাড় দেয়। ক্রেতারা সেগুলো কিনতে গিয়ে সঙ্গে অন্য পণ্যও কিনে নিয়ে আসে। তাতে ক্রেতাও খুশি থাকে কোম্পানিরও লাভ হয়।

৯০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেখে গিয়ে পেলেন ১০ শতাংশ

৯০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেখে ওয়ারীর জুতার আউটলেট 'স্টেপ' এ গিয়ে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছেন রাজীব আহমেদ। তিনি বলেন, 'আমি ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেখে কিনতে এসেছি। কিন্তু কেনার পর দেখি মাত্র ১০ শতাংশ ছাড় দেয়া হয়েছে। এটা কেমন কথা? অন্তত ৫০ শতাংশ হলেও তো মানা যেত।’

নিজেকে প্রতারিত মনে করে তিনি বলেন, ‘বিক্রি বাড়ানোর জন্য এমন চমকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের সঙ্গে চালাকি করা হচ্ছে। তারা যতো শতাংশ বিক্রি করবে তত শতাংশের ছবি লাগালে কী সমস্যা? যার মন মতো হয় সে কিনবে, যার মন মতো হবে না সে কিনবে না৷ এমন অভিনব কায়দায় পণ্য বিক্রি করে আমাদের ঠকানো হচ্ছে।’

প্রতিষ্ঠানটির একজন বিক্রয়প্রতিনিধি স্বীকার করেন, ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ের স্টিকার ঝোলানো হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছাড় মেলে ১০ শতাংশ, কখনও কখনও এর চেয়ে কিছু বেশি।

আরেকজন বিক্রয় প্রতিনিধি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা লটারির মতো। এখানে যে ছাড় দেয়া হয়েছে তা মাঝেমধ্যে কেউ কেউ পায়৷ আজকেও একজন ৯০ শতাংশ ছাড় পেয়েছে। এমন জুতার পরিমাণ শ খানেকের মতো হবে।’

যদি বেশিরভাগ পণ্যেই ছাড় ১০ শতাংশ বা তার একটু বেশি ছাড় হয়, তাহলে সেটাই বিজ্ঞপনে কেন ব্যবহার করছেন না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আসলে ব্যবসায়িক কিছু কৌশল থাকে। বিভিন্ন সময় ব্যবসার ফ্লো বাড়াতে গ্রাহকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে হয়। গ্রাহকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারলেই তারা আমাদের কাছে আসবে, পণ্য কিনবে। আর এতে ব্যবসা ভালো হবে।’

চালাকি দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে আউটলেট ত্যাগ

ফ্যাশন ব্রান্ড ফড়িংয়েও ৫০ শতাংশ ছাড় দেখে তাপস দাস ভীষণ রাগান্বিত হয়ে দোকান থেকে বের হয়ে গেছেন।

তিনি বলেন, 'অর্ধেক দামে কিনব ভেবে ঢুকেছিলাম। পরে জানতে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পাব নিশ্চিত। এতে আমার মেজাজ অনেকটা খারাপ হয়ে গেছে। তাই কিছু আর কিনিনি। এভাবে না করে একটা নির্দিষ্ট ছাড় বলে দিলেই হয়। যার সে ছাড় অনুযায়ী সামর্থ্য আছে সে কিনতে আসবে, যার নেই সে আসবে না।’

প্রতিষ্ঠানটির এক বিক্রয় কর্মী জানান, ‘পূজার সময় তোলা কালেকশনের বেশকিছু রয়ে যায়। সেগুলো বিক্রি করতে এমন ছাড়। এতে ক্রেতারা আকৃষ্ট হয়ে কাপড় কিনবে।’

১০ শতাংশ ছাড়ের ঘোষণাতেও শর্ত

এটি দেখা যায় আরএফএল বেস্ট বাই-এর রামপুরা বাজারের আউটলেটে। সেখানে ভিশন ফ্যানে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় সম্বলিত স্টিকার লাগানো আছে। তবে বাস্তবিক অর্থে কত শতাংশ পর্যন্ত ছাড় পাওয়া যাবে তা বোঝা মুশকিল। কারণ, ছাড় দেয়া পণ্যগুলোর ছাড়ের সীমাটা নির্ধারিত হয় লটারির মতো করে৷ যার ভাগ্যে যতোটুকু আসে।

আউটলেটটির একজন বিক্রয় প্রতিনিধি জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শতাংশের যে সীমা দেয়া থাকে সেটাই আসে৷ তবে মাঝেমধ্যে একটু ভিন্ন হয়। অনেক সময় দেখা যায় উল্লেখিত সীমার চেয়ে ছাড় কিছুটা কম পাওয়া যায়।

বহুল পরিচিত ফ্যাশন ব্রান্ড লা রিভে দেখা যায়, ১৩ থেকে ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়েছে বিশেষ কয়েকটি দিনের জন্য। তবে বেশিরভাগ ক্রেতাই বলছেন তারা ১৩ শতাংশই ছাড় পাচ্ছেন। বড়জোর ১৫ শতাংশ পর্যন্ত পেয়েছেন কেউ কেউ।

সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞাপন নীতিমালা চান মার্কেটিংয়ের অধ্যাপক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিজ্ঞাপন দিয়ে ছাড় দেয়ার ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন প্রয়োজন। এর মাধ্যমে বিক্রেতারা কোনো একটি পণ্যের ওপর নির্দিষ্ট ছাড় দিবে তা নির্ধারিত হবে। এতে ভোক্তারা প্রতারিত হওয়া থেকে অনেকটাই বাঁচবে।’

ভোক্তা অধিকার বিষয়ক আইনে বিজ্ঞাপনে চাতুরির এই বিষয়টি উল্লেখ করে নিষেধ করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, ‘এমন প্রলোভন দেখানো বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যবসা করার পরও তাদের কোনোভাবে আটকানো যাচ্ছে না। কারণ, তাদের ধরার মতো তেমন কোনো নির্দিষ্ট আইন নেই। যার ফলে তারা দিন দিন এভাবে সাধারণ গ্রাহকদের কৌশলে ঠকিয়ে যাচ্ছে।’

যোগাযোগ করা হলে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঢাকা জেলার সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোনো ভোক্তা যদি মনে করেন তিনি পণ্য কিনে ঠকেছেন, তাহলে সে আমাদের কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন। আমরা অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করব।’

এ বিভাগের আরো খবর