বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিপর্যয়ের মুখে বস্ত্রশিল্প: বিটিএমএ

  •    
  • ২২ অক্টোবর, ২০২২ ২২:২১

বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ‘আমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন যে, বাংলাদেশের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রাইমারি টেক্সটাইল খাতের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে। দীর্ঘদিন ধরে প্রাইমারি টেক্সটাইল খাতটি বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মধ্যে ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্ব পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে আমাদের এই খাতটি একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে।’

গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে বস্ত্রশিল্প নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। তারা বলেছেন, বস্ত্র কারখানাগুলোতে গড়ে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। গ্যাস সমস্যা তো ছিলই। সব মিলিয়ে বস্ত্র শিল্পের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত।

শনিবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে এ উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন বস্ত্র শিল্পমালিকদের সংগঠন বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন।

তিনি বলেন, ‘যেসব মিল ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশনের মাধ্যমে চালু থাকে বিশেষত ঢাকার আশপাশে- নারায়ণগঞ্জ, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, মাধবদী, আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর, শ্রীপুর, ভালুকা অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় অবস্থিত। এসব মিল মূলত গত কয়েক মাস যাবৎ গড়ে ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকে। বিদ্যুৎ থাকা সময়ে মিলগুলো মোট উৎপাদন ক্ষমতার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারে।’

বস্ত্র খাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট নিয়ে সমস্যা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে এসব কথা বলেন তিনি।

বিটিএমএ সভাপতি খোকন বলেন, ‘আমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন যে, বাংলাদেশের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রাইমারি টেক্সটাইল খাতের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে। দীর্ঘদিন ধরে প্রাইমারি টেক্সটাইল খাতটি বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মধ্যে ছিল।’

তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সামগ্রিক বিশ্ব পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে আমাদের প্রাইমারি টেক্সটাইল খাতটি একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। যে বিষয়টি ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আমাদেরকে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তা হলো জ্বালানি তথা গ্যাসের তীব্র সংকট। যার কারণে আমাদের মিলগুলোর উৎপাদন দীর্ঘদিন যাবৎ কার্যত বন্ধ রয়েছে।’

‘সমস্যার সমাধানের জন্য আমরা বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী, জ্বালানি উপদেষ্টাসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের শরণাপন্ন হয়ে আমাদের অবস্থান তুলে ধরেছি। বিভিন্ন দফায় শরণাপন্ন হওয়ার পরও এর কোনো সমাধান নেই, বরং সমস্যাটি বর্তমানে তীব্র ও অসহনীয় পর‌্যায়ে চলে এসেছে।’

খোকন বলেন, ‘২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানিতে টেক্সটাইল খাত মোট ২৯ বিলিয়ন ডলারের মূল্য সংযোজন করেছে। তবে এর মধ্যে নিটওয়্যার খাতে স্থানীয় মূল্য সংযোজনের হার ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। অন্যদিকে মূল্য সংযোজনের ক্ষেত্রে ওভেন ও ডেনিমের হার হচ্ছে ৪৫ শতাংশ।’

তিনি বলেন, ‘গত অর্থবছরে আমরা স্থানীয়ভাবে মোট ৭ বিলিয়ন মিটার কাপড়ের জোগান দিয়েছি। যার মূল্য আনুমানিক ৮ বিলিয়ন ডলারের মতো, অন্যথায় উক্ত চাহিদা পূরণের জন্য আমাদের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতো হতো, যা ডলারের বিদ্যমান সংকটকে আরও বাড়াত। শিল্প উৎপাদনের মূল নিয়ামক হচ্ছে জ্বালানি। অথচ গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে আমাদের টেক্সটাইল মিলগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ তাদের উৎপাদন সক্ষমতার ৩৫-৪০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করতে পারছে না। ছোট ও মাঝারি মানের ফেব্রিক মিলগুলোর অবস্থা আরও খারাপ।’

বিটিএমএ সভাপতি বলেন, ‘আমাদের জানামতে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, আড়াইহাজার, রূপগঞ্জ, পলাশ, কালীবাড়ি, মাধবদী ইত্যাদি এলাকায় অনেক ছোট-খাটো মিল রয়েছে। ওই সব মানুষের জীবন-জীবিকা মূলত তাঁতনির্ভর এবং মিলগুলো পরিচালিত হয় সাধারণত বিদ্যুৎ দিয়ে। ফলে বিদ্যুৎ সংকটের কারণে মিলগুলোর যে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে তা পূরণ করার কোনো বিকল্প নেই।’

‘এ ছাড়া ডায়িং মিলগুলোর সমস্যাটি অত্যন্ত প্রকট। লোড শেডিংয়ের কারণে মিলগুলোর মূল্যবান রং এবং রসায়ন নষ্ট হচ্ছে। একই সঙ্গে সাইজিং মেশিন বন্ধ থাকায় সুতাও নষ্ট হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত মিলগুলোকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে অনেকে ব্যবসা ছেড়ে দেয়ার চিন্তা করছেন।’

খোকন বলেন, প্রাইমারি টেক্সটাইল খাতে বর্তমান বিনিয়োগ দেড় লাখ কোটি টাকারও বেশি, যা আমেরিকান মুদ্রা ডলারে ১৬ বিলিয়নের মতো। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই বিভিন্ন ব্যাংকের বিনিয়োগ। মিলগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ায় ক্রমাগত লোকসানের কারণে উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন।

তিনি বলেন, ‘অনেক শিল্প ইতোমধ্যে রুগ্‌ণ হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। অপরদিকে টেক্সটাইল খাতে আগামী ২০২৫ সনের মধ্যে আরও ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হতে যাচ্ছে। ফলে যদি জ্বালানির নিশ্চয়তা না পাওয়া যায় উক্ত বিনিয়োগ নিশ্চিতভাবে অপবিনিয়োগ হতে বাধ্য।’

খোকন বলেন, ‘যারা ব্যাংকের মাধ্যমে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) ঋণ নিয়ে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি করেছে তারাও সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। অথচ এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান কঠোর । ফলে নির্ধারিত সময়ে উক্ত অর্থ পরিশোধ করতে না পারলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী মিলগুলো পরবর্তী সময়ে এই ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা হারাবেন, যদিও এর জন্য আমরা বা মিল কর্তৃপক্ষ কোনোক্রমেই দায়ী নই।’

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, ‘টাকার সঙ্গে ডলারের বিনিময় হারের তারতম্যও আমাদের জন্য আরেকটি চিন্তার কারণ। কেননা, ব্যাংক যখন উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয় তখন প্রতি ডলারের মূল্য ছিল ৮৪ থেকে ৮৫ টাকা। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংকগুলো এলসি খুলছে ১০৭ টাকা করে। এই বিশাল তারতম্যের কারণে উদ্যোক্তাদের লিমিট শেষ হয়ে যাচ্ছে আগেই। নতুন করে লিমিট না বাড়ানোয় আমাদের অনেক সদস্য মিলই সময়মতো এলসি খুলতে সমস্যায় পড়ছেন।’

‘এমনিতেই আন্তর্জাতিক বিশ্বে নানাবিধ অস্থিরতার কারণে আমরা নানাবিধ চাপের মধ্যে রয়েছি। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী মন্দা পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় জ্বালানির অভাবে যদি আমরা মিল নিরবচ্ছিন্নভাবে চালাতে না পারি তাহলে ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে আমরা শংকিত।’

বিটিএমএ সভাপতি বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি গ্লোবাল জিডিপির বিবেচনায় বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে ৪১তম। অর্থনীতির ব্যাপকতা বিবেচনায় আমাদের জ্বালানির ব্যবহারও অনেক বেশি। ক্যাপটিভে আমাদের মিলগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১৭০০ মেগাওয়াট। এ ক্ষেত্রে জ্বালানি ক্রয়ে ডলারের বর্তমান মূল্য বিবেচনায় আমাদের অবস্থান ২৫তম। অন্য দিকে বিশ্বের টেক্সটাইলের বাজারটি হচ্ছে প্রায় ৬৮০ বিলিয়ন ডলারের মতো; যেখানে বাংলাদেশের শেয়ার হচ্ছে ৬.৮ শতাংশ, যা ২০২২ সালের শেষ নাগাদ ৭ শতাংশে উপনীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

‘বাংলাদেশের জিডিপির আকার হচ্ছে ৪০০ বিলিয়ন ডলার, যেখানে শিল্প খাতে অবদান হচ্ছে ৩৩.৩২ শতাংশ, যার ৮৪ শতাংশই টেক্সটাইল ও ক্লথিং থেকে আসে। উপরোক্ত সম্ভাবনাগুলো বিবেচনায় নিয়ে এখাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে।’

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে অর্জিত মোট রপ্তানি আয়ের ৫২ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে টেক্সটাইল এবং ক্লদিং থেকে অর্জিত আয়ের পরিমাণ ৪৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে স্থানীয়ভাবে তৈরি টেক্সটাইল সামগ্রীর অবদান হচ্ছে ২৯ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ এর মাধ্যমে প্রাইমারি টেক্সটাইল সেক্টর প্রায় ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার স্থানীয়ভাবে রিটেনশন করতে পেরেছে, যা শতাংশ হিসেবে ৪৫.৫ শতাংশ।

খোকন বলেন, ‘আমাদের ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশনের মিলগুলো বার্ষিক ১৬৯.১ বিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাস ব্যবহার করে। এর বিপরীতে গ্যাস ট্যারিফ হিসাবে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার মতো বিল পরিশোধ করে। এই গ্যাস ব্যবহার এবং তার সাথে অন্যান্য ইনপুট ব্যবহারের মাধ্যমে মিলগুলো ২১ বিলিয়ন ডলারের বেশি সাশ্রয় করে থাকে।’

‘এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিমাণ গ্যাস মিলগুলোকে সরবরাহ করে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা আমরা স্থানীয়ভাবে সাশ্রয় করব কি না? এমন পরিস্থিতিতে টেক্সটাইল খাতের মিলগুলোতে যদি গ্যাসের অব্যাহত সংকট চলতে থাকে তাহলে আমাদের মিলগুলো যে ২১ বিলিয়ন ডলার রিটেনশন করেছে তা বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি সরকার ডলার ও জ্বালানি সংকট মোকাবিলার জন্য যে সাশ্রয় নীতি গ্রহণ করেছেন তা বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য।’

‘ফলশ্রুতিতে গ্যাস সংকটের কারণে মিলগুলোতে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়ে বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নতুন বেকারত্বের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সৃষ্টিসহ সামগ্রীক ভাবে অর্থনীতির সাইকেলটি সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।’

‘তাই টেক্সটাইল খাতের সম্ভাবনা, অবদান ও গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে খাদ্য পণ্যের অনুরূপ টেক্সটাইল খাতকে অগ্রাধিকার প্রদান করে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে টেক্সটাইল খাতে যেকোনোভাবেই হোক নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ অব্যাহত রাখার অনুরোধ করছি। কেননা, প্রধানমন্ত্রী আগামীতে যে বাংলাদেশের স্বপ্ন তার সিংহভাগ এ খাতটির মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে বলে আমরা মনে করি।’

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিটিএমএ সহসভাপতি ফজলুল হক ও আব্দুল্লাহ আল মামুন, পরিচালক মোশাররফ হোসেন, আবদুল্লাহ জোবায়ের, সৈয়দ নুরুল ইসলাম, মোনালিসা মান্নান প্রমুখ।

এ বিভাগের আরো খবর