পিকআপ ভ্যান চালকের ছুরিকাঘাতে শ্রমিক নিহত হওয়ার প্রতিবাদে ডাকা ধর্মঘটে বুধবার দিনভর স্থবির ছিল দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। এতে ব্যবসায়ীদের অন্তত দুই শ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে বলে দাবি করেছে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে চান মিয়া লেনের মেসার্স সামিরা ট্রেডিংয়ের সামনে সোমবার সন্ধ্যায় ছুরিকাঘাতে মাসুদ নামের এক শ্রমিককে আহত করেন পিকআপ ভ্যান চালক রাসেল। এর জের ধরে তাৎক্ষণিক রাস্তায় ঠ্যালাগাড়ি ফেলে কয়েক ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করে শ্রমিকরা। পরে ব্যবসায়ী নেতা ও শ্রমিক নেতাদের আশ্বাসে রাতে তারা কাজে ফেরে।
ঘটনার পরদিন মঙ্গলবারও বিষয়টির সুরাহা না হওয়ায় দিনভর কর্মবিরতি পালন করে শ্রমিকরা। রাতে প্রশাসন, ব্যবসায়ী নেতা ও শ্রমিক নেতাদের আশ্বাসে তারা আবারও কাজে ফিরে যায়।
বুধবার সকালে আহত ওই শ্রমিকের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে আবারও খাতুনগঞ্জের প্রধান সড়ক অবরোধ করে কর্মবিরতিতে নামেন শ্রমিকরা। স্থবির হয়ে পড়ে দেশের সবচেয়ে বড় এই পাইকারি বাজার।
দোকানের সামনে গাড়ি রাখা নিয়ে বিতণ্ডা থেকে ছুরিকাঘাত
খাতুনগঞ্জে চান মিয়া গলি দিয়ে ঢুকতেই ডান পাশের তৃতীয় দোকানের নাম মেসার্স সামিরা ট্রেডিং। এই দোকানে মাঝি (পণ্য ওঠা-নামার শ্রমিক) হিসেবে কাজ করতেন ভোলার মো. মাসুদ। সোমবার সকালে দোকানের সামনে গাড়ি রাখা নিয়ে পিকআপ ভ্যান চালক রাসেলের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয় মাসুদের। এর জের ধরে ওইদিন সন্ধ্যায় লোকজন নিয়ে এসে মাসুদকে ছুরিকাঘাত করেন রাসেল।
শ্রমিক নেতা মো. সালাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওইদিন সকালে মোজাম্মেলের (পিক-আপ ভ্যানের মালিক) ড্রাইভার রাসেল সামিরা ট্রেডিংয়ের সামনে পিক-আপটি রেখেছিলেন। মাসুদ দোকানের বেচাকেনার সুবিধার্থে গাড়িটা সরিয়ে রাখতে বলেন। এ নিয়ে দুজনের কথা-কাটাকাটি হয়। পরে মাগরিবের আযানের পর লোকজন নিয়ে এসে দোকান থেকে মাসুদকে টেনেহিঁচড়ে বের করে রাস্তার মাঝখানে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যান রাসেল ও তার সঙ্গের লোকজন। আশপাশের লোকজন মাসুদকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান। তাকে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। বুধবার সকালে তিনি মারা যান।’
একই কথা বলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও সামিরা ট্রেডিংয়ের ম্যানেজার মো. ফয়সাল। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তাদের মধ্যে কী নিয়ে ঝামেলা হয়েছিলো জানতাম না। সন্ধ্যায় রাসেল ১৫ থেকে ২০ জন লোক নিয়ে এসে তার সঙ্গে শুরুতে ঝগড়া করছিল। তাদের কয়েকজনের হাতে ছুরি ছিল। পরে দোকান থেকে বের করে রাস্তার মাঝখানে সবাই ঘিরে ধরে মাসুদকে ছুরিকাঘাত করে। হামলাকারীদের আমরা আটকানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওদের হাতে ছুরি থাকায় পেরে উঠিনি।’
খাতুনগঞ্জে বুধবার শ্রমিক ধর্মঘটে পণ্য ওঠা-নামা বন্ধ থাকায় মালামাল বোঝাই ট্রাকগুলোকে অলস বসে থাকতে হয়। ছবি: নিউজবাংলা
ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ
ঘটনার পর শ্রমিকরা কয়েক দফায় কর্মবিরতি পালন করায় লোকসানে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। আর নিজেদের লোকসানের বিষয় চিন্তা করে শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনাকে ব্যবসায়ী গুরুত্ব দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ শ্রমিকদের।
নাছির উদ্দিন নামের এক শ্রমিক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই দোকানটি ছিল তার মালিকের। সে ওই দোকানের মাঝি ছিল কেবল। দোকানির পক্ষে কথা বলতে গিয়ে তাকে মরতে হয়েছে। সে তো নিজের সম্পত্তির জন্য মারা যায়নি।
‘আমরা ব্যবসায়ীদের জন্য ২৪ ঘণ্টা কাজ করি। কিন্তু ব্যবসায়ীরা আমাদের চায় না। আমরা দিন-রাত কাজ করি, তারা টাকা গোনে আর কোটি টাকার বাড়ি-গাড়ি করে। ওরা একবার খবরও নিলো না লোকটা কীভাবে মারা গেছে।’
দুই শ কোটি টাকা ক্ষতির দাবি ব্যবসায়ীদের
শ্রমিক মাসুদকে ছুরিকাঘাতের ঘটনায় দু’দিন বন্ধ ছিল পণ্য ওঠা-নামা। এতে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের দুই শ কোটি টাকার মতো লোকসান হয়েছে বলে জানিয়েছেন চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘খাতুনগঞ্জ স্বাভাবিক থাকলে আমাদের কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যাংক লেনদেন হয়। দুদিনে এক টাকাও লেনদেন হয়নি, বেচা-বিক্রি সব বন্ধ ছিল। দুদিনে সব মিলিয়ে আমাদের দুশ’ কোটি টাকার মতো লোকসান হয়েছে।
‘তবে একজন শ্রমিক যেহেতু মারা গেছে, তার বিষয়টাও আমাদের দেখতে হবে। কারণ ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা একে অন্যের পরিপূরক। তাই খুনিদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে আমরা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি।’
ক্ষতির মুখে পড়েছেন কাঁচা পণ্য আড়তদাররাও। খাতুনগঞ্জের মেসার্স মোহাম্মদীয়া বাণিজ্যালয়ের মালিক মোজাম্মেল হক মিন্টু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এভাবে এক শ্রমিকের হাতে আরেক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা খাতুনগঞ্জের ইতিহাসে আমি আর দেখিনি। পণ্য ওঠা-নামা বন্ধ থাকায় আমাদের তো লোকসান হচ্ছেই। বিশেষ করে আমরা যারা কাঁচা পণ্য আড়তদার তাদের লোকসানটা বেশি।
‘পেঁয়াজের কথা ধরুন। পাইকারি ক্রেতারা কিনতে পারছেন না বলে আমাদের পেয়াঁজগুলো পচে যাবে। তখন কম দামে বিক্রি করতে হবে৷ এর প্রভাব আবার আমদানিকারকের ওপরও পড়বে। আনলোড করতে না পারলে সেই ব্যবসায়ীর পেয়াঁজও পচে যাবে। তখন নানা সমীকরণ মেলাতে গিয়ে দাম বেড়ে যাবে।’
কাজে ফিরেছেন শ্রমিকরা
বুধবার সন্ধ্যায় নিহত মাসুদের জানাজার পর ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের আশ্বাসে ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন শ্রমিকরা। শ্রমিক নেতা মো. সালাম বলেন, ‘আজকে জানাজার পর শ্রমিকরা সবাই কাজ শুরু করেছে। যিনি মারা গেছেন, তার ছেলেকে একটা চাকরি দেবেন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আর খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
‘তাছাড়া কাল (বৃহস্পতিবার) আমাদের প্রতিবাদ সভা আছে। শিক্ষা উপমন্ত্রী নওফেল ভাই সভায় থাকবেন। তখন আমরা আমাদের দাবি-দাওয়া জানাব।’