‘চঞ্চল টাকা অঞ্চলে বেঁধো না’– ব্যাংকে টাকা রাখা উৎসাহিত করতে তিন দশক আগে এটি জনপ্রিয় স্লোগান ছিল। দুর্দিনের জন্য মানুষকে সঞ্চয়ে উৎসাহিত করতে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। ব্যাংক কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে ছুটে বেড়াতেন। ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের উচ্চ মুনাফা দেয়ায় দেশে সঞ্চয়কারীরা ব্যাংকমুখী হয়।
পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। ইতিহাসের পুনারাবৃত্তিতে ফের আঁচলে টাকা বেঁধে রাখার সময় এসেছে। একে তো ব্যাংকঋণের সুদহার কম, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এসব কারণে মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। আবার নিরাপদ বিনিয়োগের খাতও সীমিত। ফলে সঞ্চয়কারীদের এখন বড়ই দুঃসময় যাচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারণে আমানতকারীদের মুনাফা অনেক কমে গেছে। ব্যাংক থেকে সঞ্চয় তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। তবে যারা কেবল সুদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল, তারা সঞ্চয় ধরে রেখেছেন।
ব্যাংক খাতে আমানতের সুদহার এখন মূল্যস্ফীতির হারের অনেক নিচে। সব ধরনের আমানতের সুদের হারের গত আগস্টে ৪ দশমিক ০৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ওদিকে চলতি বছরের আগস্টে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ১১ বছরে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা ৯ দশমিক ১০ শতাংশে নেমে এলেও এখনও তা ব্যাংক সুদের হারের চেয়ে অনেক বেশি।
মূল্যস্ফীতির বিদ্যমান হার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা। তারা মনে করেন, সরকার যে পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি গণনা করছে, তা ত্রুটিপূর্ণ। বর্তমান বাস্তবতার বিচারে দেশে মূল্যস্ফীতির হার সরকারি পরিসংখানের দ্বিগুণ বলে দাবি করেন তারা।
দেশে আমানতকারীদের প্রকৃত সুদের হার নির্ধারণ করা হয় মূল্যস্ফীতির হার বাদ দিয়ে। ফলে সঞ্চয়কারীদের মুনাফা খেয়ে ফেলছে মূল্যস্ফীতি। তার ওপর ব্যাংকে জমা টাকার ওপর নির্ধারিত হারে আবগারি শুল্ক কেটে রাখা হয়। ফলে লাভের পরিবর্তে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন গ্রাহকরা।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ব্যাংকে আমানত সুদের হার মূল্যস্ফীতি হারের চেয়ে কম হলে গ্রাহক ক্ষতির সম্মুখীন হন। অন্যদিকে সুদের হার মূল্যস্ফীতি থেকে বেশি হলে গ্রাহক লাভবান হন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক ঊর্ধ্বতন পরিচালক বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক মানুষ আছেন, যারা আমানতের বিপরীতে সুদ উত্তোলন করে সংসার চালান। তাদের মধ্যে আছেন সমাজের অধিকাংশ নিম্নবিত্ত ও বয়স্ক মানুষ। অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংকের সুদের টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।’
এর কারণ ব্যাখ্যা করে জায়েদ বখত বলেন, ‘একজন আমানতকারী ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রেখে যে পরিমাণ সুদ পাচ্ছেন, তার চেয়ে পণ্য ও সেবা কিনতে আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ হচ্ছে। সে জন্য মূল্যস্ফীতির চেয়ে সুদের হার বেশি থাকা উচিত।’
ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক আমানতকারী ব্যাংক থেকে তাদের আমানত তুলে নিতে শুরু করেছেন এবং জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় সামলাতে অনেকে নতুন করে সঞ্চয় করতে পারছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জুনে ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত বছরের জুনে ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ।
বর্তমানে খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, পোশাক-পরিচ্ছদ, জিনিসপত্রের দামসহ জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক গুণ বেড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সঞ্চয় নির্ভরশীল স্বল্প ও নির্ধারিত আয়ের মানুষের জীবনযাপন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
রাজধানীর শ্যামলীর বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী আবদুর রহমান হতাশা প্রকাশ করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সব জিনিসের দাম বেড়েছে। কিন্তু ব্যাংকে যে টাকা রেখেছি, সেখান থেকে আমার আয় একই রয়ে গেছে।’
আবদুর রহমান বেসরকারি ব্যাংকে ১০ লাখ টাকার স্থায়ী আমানত (এফডিআর) করেছেন। সেখান থেকে সাড়ে ৫ শতাংশ হারে সুদ/মুনাফা পান।
আবদুর রহমান বলেন, সম্প্রতি জিনিসপত্রের দাম যে হারে বেড়েছে, সে হিসাবে ব্যাংক থেকে যা পাচ্ছি, তা খুবই কম।' তিনি প্রশ্ন করে বলেন, ‘ব্যাংকে টাকা জমা রেখে লাভ কি?’
আগারগাঁওয়ের গৃহিণী হামিদা বানু বলেন, ‘ব্যাংকে টাকা রাখলে বেশি সুদ পাওয়া যায় না। সঞ্চয়পত্রের সুদও কমিয়ে দিয়েছে সরকার। আবার ক্রয়ের সীমা বেঁধে দিয়েছে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে ভরসা নেই। আমাদের বাঁচার কোনো পথ আর রইল না।’
গবেষণা সংস্থা পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ঋণের ওপর থেকে ৯ শতাংশ সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা প্রত্যাহার করা। এটা বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।’
২০২০ সালের এপ্রিলে এই সীমা নির্দিষ্ট করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন অবশ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ছিল।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর থেকে দেশে মূল্যস্ফীতির সূচক ঊর্ধ্বগামী হয় এবং তা অব্যাহত আছে।
বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি আনিস এ খান বলেন, ‘আমানত হলো ব্যাংকের রক্তপ্রবাহ। এটাই ব্যাংকের অর্থের মূল উৎস। ফলে আমানতের সুদের হার আর কমানো ঠিক হবে না। তার মতে, ব্যাংকের মুনাফার ওপর অনেক আমানতকারী নির্ভরশীল। ব্যাংকে টাকা রাখার জন্য কিছু প্রাপ্তি তো আমানতকারীর থাকতে হবে।’
মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে অবশ্য এরই মধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত সেপ্টেম্বরে সুদের হার বা পলিসি রেট বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়। এ নিয়ে গত পাঁচ মাসে তিন দফা বাড়ানো হলো পলিসি রেট।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পলিসি রেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও বাস্তবতা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এর প্রভাব পড়েনি।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, ঋণের সুদহারের সীমা প্রত্যাহার করা না হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই প্রচেষ্টা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো ইতিবাচক ফলাফল আনবে না।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেননা, বেশির ভাগ ব্যাংক এখন তারল্য সংকটে। সুদের হার বাড়ালে ব্যাংকগুলোতে হয়তো আমানত বাড়বে না, তবে সাধারণ মানুষের জন্য নিত্যপণ্য ক্রয় কিছুটা সহজ হবে।’
মনসুর আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যদি ঋণে সুদের হারে ঊর্ধ্বসীমা প্রত্যাহার করে, তাহলে ব্যাংকগুলো আমানতের ওপর সুদের হার বাড়াতে পারবে।’