ব্যাংকের মতোই ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে হচ্ছে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বা সিআইবি। অর্থাৎ কেন্দ্রীয়ভাবে সংগ্রহ করা হবে ঋণ-আমানত ও গ্রাহকের সব তথ্য। সিআইবির ক্ষেত্রে সার্বিক দিক পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তথ্য সরবরাহ করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এমআরএ। দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে শুরু হবে পাইলট কার্যক্রম।
দেশে কাজ করা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) নিবন্ধিত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮৮১টির বেশি। প্রায় ২২ হাজার শাখার মাধ্যমে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে এসব প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওগুলোর ঋণ আদায়ের হার ৯৮ ভাগের বেশি।
এমআরএর এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. ফসিউদ্দিন বলেন, ‘গ্রামীণ চাহিদার বেশিরভাগ অর্থের জোগান দেয় ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তাদের ঋণ ও আমানতের সঠিক তথ্য নেই। কে কয়টি প্রতিষ্ঠান থেকে কত টাকা ঋণ নিচ্ছে তা কেন্দ্রীয়ভাবে জানা সম্ভব হচ্ছে না। সিআইবি চালু হলে সেসব তথ্য জানা সহজ হবে।’
এনজিওদের জোট সিডিএফের নির্বাহী পরিচালক আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে সিআইবি-র দাবি দীর্ঘদিনের। অনেকদূর এই কার্যক্রম এগিয়েছে। এর ফলে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।’
কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক
ক্ষুদ্রঋণে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বা
সিআইবি কাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে অনেকদূর কাজ এগিয়ে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) সঙ্গে যুক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৫০টি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের তথ্য সরবরাহ করেছে এমআরএ। পাইলট ভিত্তিতে কাজ শুরু করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সফটওয়্যারে আপলোড দেয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের শাখা, গ্রাহক, ঋণ ও আমানতের তথ্য।
প্রথম ধাপে সব প্রতিষ্ঠানের ২০২১ সালের ডাটা চূড়ান্ত করে ডাটাবেজে আপলোড করা হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির ডাটা সংগ্রহ করে ভুল যাচাই করা হচ্ছে। নির্ভুল ডাটা পেয়ে জুন থেকে ৩ মাসের ডাটা দিয়ে টেস্টিং কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।
দ্বিতীয় ধাপে আরও ৫০টি শাখার (২৫টি শাখার বেশি প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করে) ডাটা তৈরি ও বৈধতার প্রক্রিয়া চলমান।
এনআইডি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সভায় চুক্তি সম্পাদনের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে এনআইডি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
কেন দরকার
বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রাহক কে, কী পরিমাণ ঋণ নিচ্ছে তার তথ্য সংরক্ষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণের তথ্য নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে রয়েছে একটি ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি)।
কিন্তু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান, সমবায় সংস্থাসহ আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঋণ দেয়। এগুলোর কোনো ঋণ তথ্যভাণ্ডার নেই। ফলে একই গ্রাহক একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারছেন।
একজন গ্রাহক কটি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান থেকে কী পরিমাণ ঋণ নিচ্ছে তা জানে না সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠান। ঋণের ধরন, টাকার ব্যবহার এবং খেলাপি ঋণের বিষয়েও স্পষ্ট ধারণা নেই।
গ্রাহকদের অনেকেই এক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি হয়ে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিচ্ছেন। তারা এক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের দেনা শোধ করছেন। এতে ক্ষুদ্রঋণ খাতের শৃঙ্খলা যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি ঝুঁকিও বাড়ছে। এসব মোকাবিলার জন্যই ক্ষুদ্রঋণের জন্য আলাদা একটি সিআইবি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবির সঙ্গে ক্ষুদ্রঋণের সিআইবির একটি সংযোগ গড়ে তোলা হবে। তাতে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের সব ধরনের ঋণের তথ্যই সহজে পেয়ে যাবে। একই সঙ্গে সব ধরনের ঋণখেলাপিদের শনাক্ত করা সহজ হবে।
ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ
সারা দেশে এমআরএ নিবন্ধিত প্রায় ৮৮১টি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ৭৪৭টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ২২ হাজার শাখার মাধ্যমে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দেশের তিন কোটি ৫২ লাখের বেশি পরিবার ক্ষুদ্রঋণ পরিষেবার আওতায় রয়েছে। পরিবারপ্রতি গড়ে চারজন ধরা হলে প্রায় ১৪ কোটি মানুষ অর্থাৎ দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষুদ্রঋণে সম্পৃক্ত রয়েছে।
এনজিওগুলোর জোট ক্রেডিট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরামের (সিডিএফ) তথ্যমতে, গ্রামীণ অর্থায়নের প্রায় ৭৩ শতাংশ জোগান আসে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশ কৃষি এবং ৩১ শতাংশ বিনিয়োগ হয় ক্ষুদ্র উদ্যোগ খাতে।
জিডিপিতে ক্ষুদ্রঋণের অবদান ১৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
সিডিএফের মতে, গ্রামীণ ও সেমি-আরবান অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র, উৎপাদনশীল ও সেবা খাতে ক্ষুদ্র ও উদ্যোগ ঋণের ধারাবাহিক সরবরাহ না থাকলে দেশে বিদ্যমান দারিদ্র্য হারের সঙ্গে প্রায় ১৪ শতাংশ দারিদ্র্য যুক্ত হতো। কারণ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি অর্থাৎ প্রতি মাসে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে থাকে, যার সিংহভাগই গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে বিনিয়োগ হয়।