অথনৈতিক চাপ নানা টানাপড়েনের মধ্যে ফেলেছে শহুরে মধ্যবিত্তদের। জীবনযাত্রার ব্যয় একটানা বেড়ে চলার উল্টো দিকে নির্ধারিত আয়সীমার কারণে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। অনেক পরিবারে উপার্জনও কমেছে, অনেকে হারিয়েছেন চাকরি। সব মিলিয়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চ মধ্যবিত্ত সবার জীবনে পড়েছে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব।
মধ্যবিত্তের সংকট তীব্র হওয়ার ছাপ পড়েছে নগরের বাসাভাড়ায়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দেখা গেছে, উচ্চ মধ্যবিত্তদের বসবাসের এলাকা হিসেবে সাধারণভাবে পরিচিত অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে ফাঁকা পড়ে আছে অনেক বাসা। এসব অঞ্চলের অনেকে কিছুটা কম ভাড়ায় বাসা নিচ্ছেন অন্য এলাকায়।
আবার মাঝাড়ি মধ্যবিত্তরা তাদের এলাকা ছেড়ে আরও কম ভাড়ার বাসা নিচ্ছেন। নিম্ন মধ্যবিত্তরাও হাঁটছেন একই পথে।
করোনাপরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা ও সাম্প্রতিক কয়েক মাসে জীবনযাপনে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান, ধানমন্ডি, শান্তিনগর, বনানী, লালমাটিয়া থেকে অনেকেই বাসা পরিবর্তন করে কম ভাড়ার বাসায় চলে যাচ্ছেন। ফলে ওই সব এলাকায় এখন বাসা ভাড়ার বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেও ভাড়াটিয়া পাচ্ছেন না অনেক ফ্ল্যাট মালিক।
সাবেক সরকারি কর্মকর্তা সানাউল হক থাকতেন ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কের একটি ভাড়া বাসায়। এখন তিনি মিরপুরের ষাট ফিট এলাকায় নতুন বাসা নিয়েছেন। একভাবে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক আব্দুল গণি সম্প্রতি শান্তিনগর থেকে বাসা পরিবর্তন করে নতুন বাসা নিয়েছেন পাশের এলাকা শান্তিবাগে।
সানাউল হক ধানমন্ডিতে যে বাসায় থাকতেন সেটি ছিল চার কক্ষের, ভাড়া ৫৫ হাজার টাকা। এর সঙ্গে সার্ভিস চার্জ ছিল সাত হাজার টাকা। এখন তিনি মিরপুরে যে বাসায় আছেন সেটিও চার কক্ষের, তবে ভাড়া অর্ধেক। নতুন বাসার ভাড়া ২৫ হাজার টাকা, সঙ্গে সার্ভিস চার্জ পাঁচ হাজার টাকা।
আব্দুল গণি শান্তিনগর তিনি যে বাসায় থাকতেন সেটির ভাড়া ছিল ৪২ হাজার টাকা, সঙ্গে সার্ভিস চার্জ পাঁচ হাজার টাকা। এখন তিনি শান্তিবাগে যে বাসা নিয়েছেন সেটির ভাড়া ২২ হাজার টাকা ও সার্ভিস চার্জ চার হাজার টাকা।
ব্যক্তিগত কিছু জরুরি প্রয়োজনে ধানমন্ডির সেন্ট্রাল রোডে বাসা নিতে চেয়েছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মাসুদুর রহমান। তবে অনেক বাসা ফাঁকা পেলেও ভাড়ার সঙ্গে নিজের হিসাব মেলাতে না পারায় তাকে একটু কমে মগবাজারের দিকে বাসা নিতে হয়েছে।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সেন্ট্রাল রোডে অনেক বাসা খালি পড়ে আছে। তবে ভাড়া অনেক বেশি। সাধারণত এই এলাকায় বাসা কখনও ফাঁকা থাকে না। আমি যে ধরনের বাসা খুঁজছি তেমন বাসা ওখানে থাকলেও ভাড়ার সঙ্গে পেরে উঠিনি। তাই একই রকম বাসা আমি মগবাজার দিলু রোডে নিয়েছি।'
লালমাটিয়া, সিদ্ধেশরী, গুলশান, বনানী এলাকায় কয়েক দিন ঘুরে অনেক বাসায় 'টু-লেট' ঝুলতে দেখা গেছে। বেশিরভাগ ভবনের দারোয়ান জানান, দুই থেকে তিন মাস ফাঁকা পড়ে আছে ফ্ল্যাটগুলো।
লালমাটিয়ায় আগে বাসা ছিল এমন একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, 'আমি যে ফ্ল্যাটে ছিলাম তার ভাড়া ছিল ৩৬ হাজার টাকা, সার্ভিস চার্জ সাত হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ৪৩ হাজার টাকা। আমার অফিস ধানমন্ডিতে, তাই লালমাটিয়া থাকাই সুবিধাজনক ছিল।'
তবে আর্থিক চাপ বেড়ে যাওয়ায় লালমাটিয়ার বাসা ছেড়ে মোহাম্মদপুরে যেতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। এখন তাকে বাসার পেছনে মাসে ব্যয় করতে হচ্ছে ২৮ হাজার টাকা।
সিদ্ধেশরী এলাকার সুধী সমাজ নামে পরিচিত গলির বাসার চাহিদা অনেক দিন ধরে। এ এলাকার পাশে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল থাকায় কখনও ফাঁকা থাকে না বেশিরভাগ ফ্ল্যাট। তবে গত দুই বছরে চিত্র বদলে গেছে।
সুধী সমাজ গলির একটি বাসা দুই মাসের বেশি সময় ধরে ফাঁকা পড়ে আছে। তিন বেড রুমের বাসাটি কেন ভাড়া হচ্ছে না জানতে চাইলে ভবনের দারোয়ান আনিসুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, 'আগে যিনি ছিলেন তিনি অনেকদিন ধরেই ছিলেন। তবে মালিক ভাড়া বাড়ানোর পর তিনি আফতাব নগর এলাকায় চলে গেছেন। এরপর নতুন ভাড়াটিয়াও পাওয়া যাচ্ছে না।'
দারোয়ান আনিস বলেন, ‘আগে যে ছিল তাদের ভাড়া সব মিলিয়ে ৩৪ হাজার টাকা পড়ত। এখন মানুষের এত টাকা নাই যে এত বেশিতে বাসা নেবে।'
বেশি ভাড়ার বাসা যেসব এলাকায় সেখানকার অনেকেই এভাবে কম ভাড়ার এলাকায় যাচ্ছেন। কেবল উচ্চ মধ্যবিত্তই নন, এর চেয়ে কম আর্থিক সঙ্গতির মধ্যবিত্তরাও অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ার বাসা খুঁজছেন।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাইমুন ইসলাম আলম সম্প্রতি মিরপুর ১২ নম্বর সেকশন থেকে হাতিরঝিল সংলগ্ন বাগিচারটেক এলাকায় বাসা নিয়েছেন।
সাইমুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার আগের বাসার ভাড়া ছিল মাসে ১৫ হাজার, এখন বাগিচারটেক এলাকায় ১৪ হাজারের মধ্যে বাসা পেয়ে গেছি। এখান থেকে আমার অফিসের দূরত্বও বেশ কম।’
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে ঢাকার যেসব এলাকায় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে বাসা পাওয়া যাচ্ছে সেখানে চাহিদা সবচেয়ে বেশি। টু-লেট বিজ্ঞাপন দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাড়া হয়ে যাচ্ছে ফ্ল্যাট।
আর্থিক সংকটের কারণে মধ্যবিত্তদের বাসা পরিবর্তনের তথ্য স্বীকার করছেন ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, 'এখন এমন অনেক বাসা ফাঁকা পড়ে আছে যেগুলোর ভাড়া বেশি। এর প্রধান কারণ মানুষের আয় আগের মতোই আছে, তবে ব্যয় বেড়েছে। যেহেতু আয় বাড়েনি তাই তাকে বাসা ছেড়ে দিতে হচ্ছে। এটা একটা অর্থনৈতিক মন্দা বলা যায়।'
ভোক্তা অধিকারবিষয়ক সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। জিনিসপত্রের দাম বেশি, তাই খরচপাতিও বেড়ছে। সে জন্য ভাড়াটিয়ারা বাসস্থানে সাশ্রয় করতে চাচ্ছেন।'
তিনি বলেন, 'আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য তৈরির জন্যেই এমন ঘটছে। নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। অনেকেই এখানে পরিবার নিয়ে থাকতেন। তারা পরিবারের সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে বাসাবাড়ি ছেড়ে দিয়ে মেসে উঠছেন।'