অসাধু ব্যবসায়ী, কারবারি ও বিপণন ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেই ডিমের দাম বেড়েছে। ডিমের দাম বৃদ্ধির জন্য শুধু খামারিদের দায়ি করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন মৎস ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।
এ জন্য উৎপাদনের পাশাপাশি বিপণন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে বলে জানান মন্ত্রী।
শুক্রবার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ মিলনায়তনে বিশ্ব ডিম দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তিনি।
শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘কিছু অসাধু ব্যবসায়ী, কারবারি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টি করে। বাজার ব্যবস্থাপনায় জড়িতদের সঙ্গে পোল্ট্রি বা ডিম উৎপাদনে সম্পৃক্তদের এক করে অভিযুক্ত করলে বিষয়টি নির্দয় হবে। কারণ, উৎপাদন ও বিপণন দুটি আলাদা অংশ।’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন শ ম রেজাউল করিম। বিশেষ অতিথি ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশীদ।
‘প্রতিদিন একটি ডিম, পুষ্টিময় সারা দিন’ স্লোগান সামনে রেখে প্রতিবছরের মতো এ বছরও বাংলাদেশে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পালন হয় বিশ্ব ডিম দিবস।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ওয়ার্ল্ড পোল্ট্রি সায়েন্স (ওয়াপসা) বাংলাদেশ শাখা ও বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) যৌথভাবে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।
এ ছাড়া দেশের ৬১ জেলা, সব বিভাগীয় শহর এবং চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার, ডিমের পুষ্টিগুণবিষয়ক জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে শোভাযাত্রা, বিদ্যালয় ও এতিমখানায় ডিম বিতরণ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।
শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘বর্তমানে ডিমের উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু ডিম উৎপাদনে ব্যয় বেড়েছে। পোল্ট্রি উৎপাদন খাতে সম্পৃক্তরা এগিয়ে আসার কারণে ডিম উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। ডিম ও মাংস উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন তারা।’
সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ডিমের ভারসাম্যপূর্ণ মূল্য নিশ্চিত করা হবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘উৎপাদনকারী, বিপণনে জড়িত এবং ভোক্তা এসব বিষয় ভারসম্য নিশ্চিত করে ডিমের দাম সমন্বয় করা হবে। পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাজার ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন উইং এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ডিমের মূল্য বৃদ্ধিজনিত সমস্যার সমাধান করা হবে।
শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘করোনা ও রমজানের সময় ভ্রাম্যমাণ ব্যবস্থায় কম দামে গরুর মাংস, ডিমসহ অন্যান্য পণ্য আমরা বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেছি। ভর্তুকি না দিয়েও কম দামে অনেক পণ্য সর্বত্র দেয়া হয়েছে। বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টি নজরদারিতে নিলে আরও ভারসাম্যপূর্ণ মূল্য ডিমের ক্ষেত্রে আসবে।’
করোনা পরিস্থিতিতে যারা পোল্ট্রি ও ডিম উৎপাদনে সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের অনেক ভোগান্তি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ খাতে যারা বিনিয়োগ করেছে তাদের ক্ষয়-ক্ষতি ভুলে গেলে চলবে না। পোল্ট্রি ও ডিম উৎপাদনে যারা প্রান্তিক পর্যায়ে সম্পৃক্ত, তাদের করোনাসহ অন্যান্য পরিস্থিতি বিবেচনা করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় নগদ প্রণোদনা দিয়েছে।’
ডিমের দাম সবার জন্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে কোনো উদ্যোগ আছে কিনা এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ‘রাষ্ট্র পোল্ট্রি খাতে সম্পৃক্তদের সহায়তার চেষ্টা করছে। দেশে কেউ প্রাণী ও মাছের খাবার তৈরির কারখানা বা শিল্প স্থাপন করতে চাইলে সরকার আমদানির কর মওকুফ করে দিচ্ছে। বৈশ্বিক সংকটের সমাধান সরকারের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। সরকারের সুযোগ করে দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি থাকলে সেটা বিবেচনা করা হবে। সরকারের সাধ্যের মধ্যে পোল্ট্রি ও ডিম উৎপাদনে সম্পৃক্তদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
ডিমের দামের সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে অপর এক প্রশ্নের উত্তরে রেজাউল করিম জানান, ডিমের মূল্য বৃদ্ধিতে কোথাও সিন্ডিকেট থাকলে বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্তদের সঙ্গে কথা বলে সেটা দূর করা হবে। মনোপলি ব্যবসার মাধ্যমে ডিমের দাম নির্ধারণ করে জনগণকে জিম্মি করার কোনো ব্যবসায়িক প্রচেষ্টা যদি থাকে নিশ্চয়ই সরকার সেটা মেনে নেবে না।
পাশাপাশি উৎপাদনে যে প্রকৃত ব্যয় হচ্ছে, যারা প্রচুর বিনিয়োগ করছেন তাদের ব্যয়ের চেয়ে কম মূল্যে ডিম বিক্রি করতে বলা যায় না। আবার, অতি মুনাফালোভীরা ইচ্ছেমতো মুনাফা করবে, আর মানুষকে জিম্মি করে রাখবে এটাও করতে দেয়া হবে না বলে জানান।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব নাহিদ রশীদ বলেন, ‘ডিম হচ্ছে সবচেয়ে সাশ্রয়ী মূল্যের উৎকৃষ্ট একটি প্রাণিজ আমিষ। বিগত বছরগুলোর তুলনায় দেশে ডিমের উৎপাদন অনেক বেড়েছে। আমরা চাই দেশের মানুষ যেন কম দামে ডিম খেতে পারে। ডিম দিয়ে তৈরি ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য রপ্তানির কথাও ভাবতে হবে।’
অনুষ্ঠানে ‘ডিম: প্রকৃতির এক বিস্ময়কর সৃষ্টি’ শিরোনামে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. বজলুর রহমান মোল্লা।
আলোচনায় অংশ নেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (উৎপাদন) ডা. রেয়াজুল হক ও বারডেম হাসপাতালের পুষ্টি বিভাগের প্রধান পুষ্টিবিদ শামসুন্নাহার নাহিদ মহুয়া।
এ সময় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শ্যামল চন্দ্র কর্মকার, বিপিআইসিসি ও ওয়াপসা-বাংলাদেশ শাখার সভাপতি মসিউর রহমানও বক্তব্য রাখেন।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে রেজিস্টার্ড পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা ৮৬ হাজার ৫৪১টি। ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি ৩৫ লাখ পিস ডিম উৎপাদন হয়েছে। ১০ বছরের মধ্যে এই উৎপাদন তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে।
বিপিআইসিসির হিসাবে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ডিমকেন্দ্রিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
এই বড় শিল্পের সুরক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দেশের ৬১ জেলায় প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন (এলডিডিপি) প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বলেও জানানো হয়।