মিনিকেট নামে ধান আছে কি নেই, এ নিয়ে বিতর্কের যেন শেষ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই নামে বাজারে চাল আনা যাবে না। এ নিয়ে আইন করার উদ্যোগের কথাও বলা হচ্ছে।
তবে মিল মালিক ও চাষিরা জোর দিয়ে বলছেন, এই নামে ধান আছে এবং তার চাষ বেশ লাভজনকও।
সরকার যদি এই নামে চাল বাজারে আনতে না দেয়, তাহলে এই ধানের নতুন নাম কী হবে, এই আলোচনা ছাপিয়ে ভোক্তাদের মনে নতুন যে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, সেটি হলো, চালের দাম কমবে কি না।
কুষ্টিয়ার চাল কিনতে আসা এক কলেজছাত্র বলেন, নাম যাই হোক, কোথাও যেন মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা না হয়, সেটিকেই নজর রাখা উচিত।
গত এক বছরে অন্যান্য নানা পণ্যের মতো চালের দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিও মানুষকে সমস্যায় ফেলেছে। কী কারণে দাম বেড়েছে, সেখানে কোনো কারসাজি আছে কি না, বা যে দামে বিক্রি হচ্ছে, সেটি যৌক্তিক কি না, তা খতিয়ে দেখতে কার্যকর উদ্যোগ নেই, কিন্তু চালের নাম কী, তা নিয়ে আলোচনার শেষ নেই।
কুষ্টিয়ার খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুবীর নাথ চৌধুরী অবশ্য মনে করেন, মিনিকেট নামে চাল বাজারজাত করতে না পারলে ভোক্তারা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন।
তিনি বলেন, ‘ধানের যে নাম সরকার সেই নামেই চাল বাজারজাত করার সেই নামে বাজারজাতের আইন করতে যাচ্ছে। এতে বাজার মনিটরিং আরও সহজ হবে। ন্যায্য মূল্য পাবে ভোক্তারা।’
মিনিকেট ধান আছে, জোর দাবি মিল মালিকদের
কুষ্টিয়ার খাজানগর, সরু চালের সবচেয়ে বড় মোকাম। এখানে রয়েছে চার শতাধিক হাসকিং মিল। বাংলাদেশে যে এক হাজার দুই শটির মতো অটোমেটিক রাইস মিল আছে তার মধ্যে ৫২টিই এখানে।
বাংলাদেশ অটো রাইস মিল অ্যাসোসিয়েশনের কুষ্টিয়া জেলার শাখার সাধারণ সম্পাদক মফিজুল ইসলাম জোর দিয়ে বললেন, মিনিকেট নামে ধান আছে।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘নব্বইয়ের দশকে ভারতে কৃষকদের দেয়া মিনিকিট এর মধ্যে পাওয়া এক ধরনের উচ্চ ফলনশীল ধানের বীজ আসে যশোর জেলার সীমান্ত এলাকায়। সেখান থেকে মিনিকেট নামে এই ধানের চাষ শুরু হয়।
‘মিনিকেট নামে ধান না থাকলে ট্রাকে ট্রাকে ধান আমরা কিনে আনছি তাহলে সেটার একটা নাম ঠিক করতে হবে।’
কুষ্টিয়া জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন প্রধান বলেন, ‘কুষ্টিয়ার পার্শ্ববর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, যশোরের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে এই ধানটা আসে। এটা মিনিকিট নামে প্রথম যশোর অঞ্চলে আসে। খুলনা বিভাগে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে এই ধানের চাষ করা হয়।’
এই ধান চাষ করেই কৃষকরা পাকা বাড়ি করতে পেরেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সরকারিভাবে হয়ত এই নামে কোনো ধানের জাত নেই। কিন্তু কৃষকরা মিনিকেট নামেই আবাদ করছেন, বিক্রিও করছেন সেই নামেই।
কুষ্টিয়ার হরিপুর মাঠে মিনিকেট নামেই ধানের চাষ করা হয়। ছবি: নিউজবাংলা
‘সরকার এখন মিনিকেট নামে ধান নেই বলছে। এই নামে চাল বাজারজাত করতে দেবে না। এতে মিল মালিকদের কোনো সমস্যা হবে না। সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হলে আগে কৃষকদের কাছে যেতে হবে। সেখান থেকে আগে ধানের জাতের নাম পরিবর্তন করতে হবে।
‘যে নাম সরকার ঠিক করে দেবে বা যে নামে আমরা ধান কিনব, সেই নামেই চাল বাজারে দেব। কিন্তু ভোক্তারা তাদের প্রিয় সেই মিনিকেট চালই খুঁজবে।’
কৃষকরা কী বলছেন
কুষ্টিয়ার মো. সালিম হরিপুর মাঠে মিনিকেট নামেই ধানের চাষ করেন। তিনি বলেন, ‘পৌষ মাসে এটা লাগানো হয়। অন্য ধানের চেয়ে ফলন ভালো হয়, দামও বেশি পড়ে।’
সদর উপজেলার দোস্তপাড়ার রফিকুল ইসলাম প্রতিবছর ৮ থেকে ৯ বিঘা জমিতে ধান চাষ কনের। তিনি বলেন, ‘আমি দোস্তপাড়া, কবুরহাট ও স্বর্গপুর মাঠে নিজের জমিতে মিনিকেট করি। ভালো লাভ হয়।’
অনেক কৃষকই মিনিকেট ধানের আবাদ করছেন বলেন তিনি।
‘নাম যাই হোক, দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকুক’
কুষ্টিয়ায় চাল কিনতে আসা ছাত্র আরমান হোসেন চালের নাম না, বেশি চিন্তিত দাম নিয়ে।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মিনিকেট থাকবে কি থাকবে না এ নিয়ে এত মাথাব্যথা নেই আমাদের। নাম দিয়ে কী হবে? চালের দাম কমানো যায় সে উদ্যোগ নিক সরকার। আমাদের দরকার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসা।’
কুষ্টিয়া সচেতন নাগরিক কমিটি সনাকের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল আলম টুকু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মিনিকেট নামে যেভাবে বাজারে চালে ভরে আছে, অতটা চিকন ধান উৎপাদন হয় না। মিল মালিকরা একটা প্রতারণা করেন এটা পরিষ্কার। তবে এ জন্য আইন করার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। মিল মালিকদের সরকার নিষেধ করলেই হবে। এ ক্ষেত্রে জোরাজুরি করলে হিতে বিপরীত হবে। মিনিকেট এমন একটা ব্রান্ড হয়ে গেছে, এটা নিষেধ করে আইন হলে এর প্রতি মানুষের আগ্রহ আরও বাড়বে। গোপনে বেশি দামে বিক্রি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। বরং সরকারের গোড়ায় হাত দেয়া উচিত।’
সেটি কেমন?
তিনি বলেন, ‘মিলে কার্যকর তদারকি দরকার। চালের দাম কমানোর কার্যকর উদ্যোগ দরকার। চাল উৎপাদনে কোনো উপাদান বিদেশ থেকে আনা লাগে না। দেশের ধান থেকে চাল হয়। এতো দাম হবে কেন? মিলগুলোতে সেই তদারকি দরকার কী দামে ধান কিনছে, আর দামে চাল বিক্রি করছে, সেটি যাচাই করা দরকার। এভাবে দাম সহনীয় রাখা গেলে সেটি হবে জনগণের জন্য কল্যাণকর।
‘সেটা না করে চালের নাম নিয়ে যেটা হচ্ছে, তাতে নাম ফুটছে ঠিকই, কিন্তু ভোক্তার কোনো লাভ হচ্ছে না।’
অবশ্য ক্রেতাদের মধ্যেও এই ধারণা প্রবল যে মোটা চাল কেটে চিকন বানিয়ে মিনিকেট নামে বিক্রি করা হয়। এদের একজন নাসিম আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমি যতদূর জানি বিআর-২৮ ও জিরা নামের যে চালটা আছে এটা ছেঁটে মিনিকেট করা হয়। সরকার মিনিকেট নামে চাল বিক্রি বন্ধ করতে যাচ্ছে এটা ভালো উদ্যোগ কিন্তু নতুন যে নামেই বাজারে চাল আসুক তা মিনিকেট হিসেবে বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
আরেক ক্রেতা আজিজল হোসেন বলেন, ‘দেশে যেহেতু মিনিটে ধান নাই সেহেতু মিনিকেট চালও থাকার কথা না। কিন্তু আমরা বাজারে দেখছি মিনিকেট চালে সয়লাব। এটাকে এক প্রকার ভেজাল কারবারই বলা চলে। কম দামের চাল মিনিকেট নামে কিনে ক্রেতারা ঠকছেন। আশা রাখি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে দ্রুতই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।’
চাল কি আসলে সরু করা যায়?
অন্য ধান কেটে সরু করে মিনিকেট নামে বাজারে ছাড়া হয় বলে যে প্রবল ধারণা আছে, সেটির বিষয়ে খাজানগরের বাজুমারা রাইস মিলের মালিক বজলুর রহমান ফকির বলেন, ‘মোটা চাল কেটে চিকন করার সুযোগ নাই। তবে আধুনিক যেসব মেশিন রয়েছে সেগুলোতে চাল পলিশ করা হয়, ময়লা, মাছি, কালো চাল বাছাই করা হয়। তার মধ্যে যদি কিছুটা চিকন হয় এটা হতে পারে।
‘কিন্তু একটা চাল কেটে আমরা দুইটা করি এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এটা যারা ছড়াচ্ছে আমি মনে করি, তারা নিন্দনীয় কাজ করছেন।’
আসলে অটো রাইস মিল কতটা সরু করতে পারে চাল? জানতে কথা হয় অটোরাইস মিল আমদানিকারক সাইফুল ইসলাম মারুফের সঙ্গে। এই প্রকৌশলী বলেন, ‘সাধারণত বিআর-৪৯ ও বিআর-৫০ জাতের ধান থেকে মিনিকেট চাল বানানো হয়।
‘এ ধানের চাল লম্বায় ৯ মিলিমিটার হয়। আর প্রস্থে থাকে ৪ থেকে ৫ মিলিমিটার। মিলগুলোতে চালের উপরিভাগের আবরণ তুলে ফেলা যায়। এটা দশমিক ৫ মিলিমিটার থেকে দশমিক ৭৫ মিলিমিটার পর্যন্ত ছেটে ফেলা যায়। তবে মোটা চাল কেটে সরু করা যায় না। কারণ, দশমিক ৭৫ মিলিমিটারের বেশি চাল ছাঁটতে গেলে চালটিই ভেঙে যাবে।’
কুষ্টিয়ার চালের আড়ত। ছবি: নিউজবাংলা
কুষ্টিয়া জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন প্রধান বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রে মোটা ধান বা মোটা চাল কেটে চিকন করার মতো কোনো রাইস মিল তৈরি হয়নি। মোটা ধান বা চাল কেটে চিকন করা হয় এই বক্তব্য যারা বলছে, তাদের এই সম্পর্কে ধারণা নেই বা বোঝার ভুল রয়েছে।’
‘নাম পাল্টালেও ক্রেতারা মিনিকেটই খুঁজবে’
বিক্রেতারা মনে করেন, যে ক্রেতারা এই চালে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, তারা নাম পাল্টালেও তাদের কাছে এসে মিনিকেট নামেই খোঁজ করবেন।
কুষ্টিয়া মিউনিসিপালিটি বাজারের চাল বিক্রেতা আহমেদ মঞ্জুরুল রিপন বলেন, ‘মিল থেকে যা আসবে, আমরা তো সেটাই বিক্রি করব। যে বস্তায় যে নাম লেখা থাকবে সে নামেই বিক্রি হবে। তবে নাম বদলে গেলেও চাল নিতে আসা ক্রেতারা ওই মিনিকেট চালই খুঁজবে।’
আরেক বিক্রেতা মো. নিশান বলেন, ‘মিল-মালিকরা আমাদের মিনিকেট বলে দেয়, আমরাও তাই বলে বিক্রি করছি। শুনছি সরকার মিনিকেট চাল নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে।’