সরকারি হিসাবেই গত সেপ্টেম্বর মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। আর ওই মাসে মজুরি বেড়েছে ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। তার আগের মাস আগস্টের তথ্য ছিল আরও ভয়াবহ। মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ; মজুরি বেড়েছিল ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ।
এর অর্থ হচ্ছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, সেই পণ্য বা সেবা পেতে এখন ১০৯ টাকা ১০ পয়সা খরচ করতে হচ্ছে। আর যে দিনমজুর-শ্রমিক বা অন্য পেশার মানুষ গত বছরের সেপ্টেম্বরে তার শ্রমের বিনিময়ে ১০০ টাকা পেয়েছেন, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে তারা পেয়েছেন ১০৬ টাকা ৮৬ পয়সা।
তবে এক বছরে আয় বাড়লেও তাতে কোনো লাভ হয়নি। কেননা এখন ১০৬ টাকা ৮৬ পয়সা আয়ের বিপরীতে মানুষকে খরচ করতে হচ্ছে ১০৯ টাকা ১০ পয়সা।
গত আট মাসে দেশে মজুরি বৃদ্ধির চেয়ে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ বেশী রেকর্ড করা হয়েছে। গ্রাফিক্স: নিউজবাংলা
এই হিসাব বলছে, দেশের দিনমজুর-শ্রমিকসহ বেসরকারি পেশাজীবীরা যে বাড়তি আয় করছেন, তা দিয়ে সামাল দেয়া যাচ্ছে না মূল্যস্ফীতির চাপ। উল্টো আরও বেশি খরচের বোঝা চাপছে তাদের মাথায়। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি আর মজুরি সূচকের মধ্যে ব্যবধান দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ২৪ শতাংশ পয়েন্ট। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমনটি আর কখনই দেখা যায়নি। সব মিলিয়ে মানুষের সঞ্চয় বা জীবনযাত্রার বাড়তি চাহিদা মেটানো দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। উচ্চবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্ত ছাড়া সবাই কষ্টে আছে।
গত ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা আট মাস ধরেই চলছে এ প্রবণতা। এই সময়ে দেশের মানুষের গড় মজুরি যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে বাড়ছে জিনিসের দাম।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মঙ্গলবার মূল্যস্ফীতি ও মজুরি বৃদ্ধির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, গত জুনেও মূল্যস্ফীতির হার জাতীয় পর্যায়ে মজুরি বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি ছিল। আগের চার মাসেও একই চিত্র ছিল দেশে। সাধারণ সময়ে মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির কিছুটা বেশি থাকে। তবে অর্থনীতির এই পরিচিত প্রবণতায় ছেদ ঘটেছে ফেব্রুয়ারি থেকে।
এর আগে করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সালের জুন মাসে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম ছিল। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, আর মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৯০। গত এক দশকের মধ্যে সেটিই ছিল ব্যতিক্রম। তবে চলতি বছরের প্রায় গোড়া থেকে আয়-ব্যয়ের হিসাবে চলছে গণ্ডগোল।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, গত ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ, আর মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ২২ শতাংশ, মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ১৫। পরের মাস এপ্রিলে মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছিল ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ, মজুরি বেড়েছিল ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। জুন মাসে দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর সূচক মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশে ওঠে, যা ছিল ৯ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বিপরীতে ওই মাসে মজুরি সূচক বেড়েছিল ৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমে আসে; ওই মাসে মজুরি সূচক ছিল ৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আগস্টে মজুরি সূচক বেড়ে ৬ দশমিক ৮০ শতাংশে ওঠে। মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ।
সবশেষ সেপ্টেম্বর মাসে মজুরি সূচক বেড়ে ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ হয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে অবস্থান করছে।
দেশে উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত ছাড়া সব মানুষই কষ্টে আছেন। ফাইল ছবি
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারি এই তথ্যই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে দেশের মানুষ কষ্টে আছেন। দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন তারা। উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত ছাড়া সব মানুষই কষ্টে আছেন।
সাধারণত মূল্যস্ফীতি ও মজুরি হার বৃদ্ধির মধ্যে পার্থক্য ১ শতাংশের মতো হয়। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি সূচক কমপক্ষে ১ শতাংশ বেশি হয়ে থাকে। যখন মূল্যস্ফীতি মজুরি বৃদ্ধিকে টপকে যায়, অর্থনীতির পরিভাষায় সেটিকে ‘অস্বাভাবিক’ বলা হয়ে থাকে। আট মাস ধরে দেশে সেটিই হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরোর মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন আছে। বিবিএসের সঙ্গে সঙ্গে বাজারের পণ্যমূল্যের বাস্তব প্রতিফলন পাওয়া যায় না।’
‘তার পরও বিবিএসের তথ্য মেনে নিয়েই যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলেও কিন্তু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, দেশের মানুষ যা উপার্জন করছে, তা দিয়ে তাদের সংসার চলছে না। মজুরি বৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি হওয়া সাধারণত অর্থনীতিতে দেখা যায় না। এখন সেটি হচ্ছে। তাও সেটি ২ দশমিক ২৪ শতাংশ পয়েন্ট বেশি। এতেই প্রমাণ হয়, মানুষ খুবই কষ্টে আছে।’
আহসান মনসুর বলেন, ’৫৫ টাকার কমে কোনো চাল পাওয়া যায় না বাজারে। ভোজ্যতেল, চিনি, ডালসহ সব জিনিসের দামই চড়া। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে পণ্যমূল্যে। বেড়েছে মানুষের পরিবহন খরচ।’
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতে। এর জেরে বেড়ে চলা খাদ্যসংকট বিশ্বকে একটি মানবিক বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিয়েছে বলে বারবার সতর্ক করছে, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা। ছোট-বড় সব দেশেই এখন মূল্যস্ফীতি বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের অবস্থাও দিন দিন খারাপ হচ্ছে।’
অর্থনীতির আরেক গবেষক সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত মার্চ মাসে আমরা এক গবেষণা চালিয়ে দেখেছি, বিবিএসের তথ্যের চেয়ে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণ। তার পরও বিবিএসের বর্তমান মূল্যস্ফীতি ও মজুরি সূচকের তথ্য নিয়েই যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলেও কিন্তু আমরা উদ্বেগজনক একটি তথ্য দেখতে পাচ্ছি।’
‘আর সেটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির হারের চেয়ে অনেক বেশি। অর্থাৎ আয় বাড়লেও মানুষের তা দিয়ে চলছে না। হয় ধারদেনা করে চলছে; না হয় কম খাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি মানুষের বাড়তি আয় খেয়ে ফেলছে।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন দেশের ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বাজারের আগুনে মানুষের অবস্থা খারাপ, শুধু খারাপ বললে ভুল হবে; খুবই খারাপ। উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত ছাড়া সব মানুষই কষ্টে আছেন। আর এই কষ্ট থেকে ক্ষোভ-হতাশা বাড়ছে। বিশেষ করে যারা নির্দিষ্ট আয়ের (ফিক্সড ইনকাম গ্রুপ) তারা খুব সংকটে রয়েছেন। সংসারের ব্যয় কাটছাঁট করতে করতে অবস্থা অনেকটা এমন যে, জামা কাটতে কাটতে দেখা যাবে আর কিছুই নেই।’
তিনি বলেন, ‘সরকার সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় গরিব মানুষকে নানাভাবে সহায়তা করছে। এর আওতা আরও বাড়াতে হবে। নিম্ন মধ্যবিত্তদের এই আওতায় নিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি কমাতে বাজারে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।’
এ অবস্থায় খোলাবাজার ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির পাশাপাশি গরিব মানুষের কষ্ট লাঘবে সেপ্টেম্বর থেকে সাশ্রয়ী দামে চাল বিক্রি করেছে সরকার। ফ্যামিলি কার্ডধারী দেশের এক কোটি পরিবার ৩০ টাকা কেজি দরে ১০ কেজি করে চাল কেনার সুযোগ পাচ্ছেন।
কিন্তু সার্বিক মূল্য পরিস্থিতি নাজুক। করোনার ধকল সামলে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আরেকটি বড় ধাক্কা দিয়েছে।
তবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান আশার কথা শুনিয়ে বলেছেন, মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে যত ধরনের পদ্ধতি আছে, সরকার সব ব্যবহার করছে।
মঙ্গলবার মূল্যস্ফীতির আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের তথ্য একসঙ্গে প্রকাশ করার সময় মন্ত্রী বলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতির কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। তবে এখন মূল্যস্ফীতি কমতির দিকে। সামনে তা আরও কমবে। দ্রব্যমূল্য কমাতে যা যা করা দরকার, সব করছি এবং ভবিষ্যতে আমরা করব।’