‘ঢাকায় টাকা ওড়ে, ধরতে জানতে হয়’ লোকমুখে প্রচলিত কথাটি আসলেই সত্যি। কারণ, সারা দেশে যত টাকা তার তিন ভাগের দুই ভাগ টাকা রয়েছে ঢাকাতেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, ক্ষুদ্র সঞ্চয় এবং মেয়াদি আমানত মিলিয়ে সারা দেশের মধ্যে ঢাকার ধারে কাছেও নেই দেশের কোনো অংশ।
জুন শেষে ঢাকা বিভাগেই রয়েছে প্রায় ৯ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকার বেশি আমানত। যা দেশের মোট আমানতের প্রায় ৬৫ শতাংশ।
আর এর মধ্যে শুধু ঢাকা জেলায় আমানতের পরিমাণ ৮ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা।
এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জে ৩১ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা এবং গাজীপুরে ২৯ হাজার ৯১৮ কোটি টাকার আমানত রয়েছে।
এর পরে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। সেখানে আমানতের পরিমাণ ৩ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এ টাকার মধ্যে চট্টগ্রাম জেলায় ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার আমানত।
এরপরে নোয়াখালীতে ১৭ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৫ হাজার ৭২০ কোটি টাকা, ফেনীতে ১৪ হাজার ৫১১ কোটি টাকা ও চাঁদপুরে ১৩ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকার আমানত রয়েছে।
আমানতের দিক দিয়ে এর পরের অবস্থানে খুলনা। ওই বিভাগে আমানতের পরিমাণ ৬৮ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।
এ ছাড়া রাজশাহীতে ৬৫ হাজার কোটি টাকা, সিলেটে ৬১ হাজার কোটি টাকা, রংপুরে ৩১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা ও ময়মনসিংহে ২৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকার আমানত রয়েছে।
সঞ্চয় ও ঋণ বিতরণে পিছিয়ে বরিশাল
অর্থ সঞ্চয় এবং ঋণ বিতরণ- দুই ক্ষেত্রেই পুরো দেশের মধ্যে পিছিয়ে দক্ষিণের জেলা বরিশাল। বিভাগটিতে বিনিয়োগ আমানতের অর্ধেকেরও কম। তবে, আমানত এবং ঋণে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ঢাকা।
গেল জুন শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ ১৫ লাখ ৭৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে সঞ্চয়ের পরিমাণ ৩১ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। আর ব্যাংক খাতে ঋণের পরিমাণ ১২ লাখ ৯৮ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে বরিশাল বিভাগে বিতরণ হয়েছে ১৫ হাজার ২০৭ কোটি টাকার ঋণ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন জেলায় কলকারখানা ও ব্যবসা করলেও ঋণ নিচ্ছেন রাজধানীর ব্যাংকের শাখাগুলো থেকেই। ফলে আঞ্চলিক বৈষম্য প্রকট থেকে আরও প্রকটতর হচ্ছে। কারণ, ঢাকায় সহজে ঋণ পাওয়া যায় এবং সমস্যা হলে সমাধানও সহজে হয়’।
বরিশালে কোন জেলায় কত ঋণ ও আমানত
বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা ও ঝালকাঠি জেলা নিয়ে বরিশাল বিভাগ। ১৯৯৩ সালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এ ছয়টি জেলা নিয়ে বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। এখানকার আয়তন ১৩ হাজার ২২৫ বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যা এক কোটির নিচে।
জুন শেষে বরিশাল বিভাগের সঞ্চয়ের পরিমাণ ৩১ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা।
এর মধ্যে বরিশাল জেলায় সঞ্চয় ১৩ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। এরপরে ভোলায় ৪ হাজার ৫১৩ কোটি, পটুয়াখালীতে ৪ হাজার ৩১০ কোটি, পিরোজপুরে ৪ হাজার ২৩৯ কোটি, ঝালকাঠি ৩ হাজার ১৬ কোটি ও বরগুনায় ১ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা আমানত রয়েছে।
বরিশাল বিভাগে বিতরণ হয়েছে ১৫ হাজার ২০৭ কোটি টাকার ঋণ।
এর মধ্যে বরিশাল জেলায় ঋণ ৫ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা। এরপরে পটুয়াখালীতে ২ হাজার ৭২৩ কোটি, ভোলায় ২ হাজার ৬০৪ কোটি, পিরোজপুরে ১ হাজার ৭২৫ কোটি, বরগুনায় ১ হাজার ৪৯৯ কোটি ও ঝালকাঠিতে ১ হাজার ৫৪ কোটি টাকার ঋণ দেয়া হয়েছে।
ঋণেও এগিয়ে ঢাকা
ঋণ বিতরণের দিক দিয়েও ঢাকা স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে। এই বিভাগে দেশের ব্যাংক-ব্যবস্থার মোট ঋণের প্রায় অর্ধেক ঋণ বিতরণ হয়েছে। পরিমাণের দিক থেকে তা ৮ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা।
ঢাকা বিভাগের ঢাকা জেলাতেই ৮ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকার ঋণ। এরপরে নারায়ণগঞ্জে ১৭ হাজার ৯৯৮ কোটি, গাজীপুরে ১২ হাজার ২০৯ কোটি, নরসিংদীতে ৬ হাজার ৮৮১ কোটি ও টাঙ্গাইলে ৫ হাজার ৬৫২ কোটি টাকার ঋণ দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগে বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও ঋণ সেভাবে বাড়েনি। চট্টগ্রামে ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলাতেই দেয়া হয়েছে ১ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ।
ঋণ বিতরণে এর পরে রয়েছে খুলনা বিভাগ, যার পরিমাণ প্রায় ৫১ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া রাজশাহীতে প্রায় ৫০ হাজার ১০৪ কোটি, রংপুরে ৩২ হাজার ৬২৫ কোটি, ময়মনসিংহে ১৭ হাজার ৮৫০ কোটি, সিলেটে ১৫ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘সঞ্চয়, আয় বৈষম্য, দারিদ্র্য সীমার নিচের জনগোষ্ঠী– সব কিছুতে উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লোক অনেক বঞ্চিত। বেশির ভাগ চাকরিজীবী ঢাকায় অবস্থান করায় আমানতও এখানেই বেশি জমা পড়ছে। আর এলাকার চেয়ে ঢাকায় যে কোনো বিষয়ে মিলছে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা।’