পুঁজিবাজারে এক যুগ ধরে যে আস্থার সংকটের কথা বলাবলি হচ্ছে, সেটি কীভাবে ফিরবে- এ প্রশ্ন আবার বড় হয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের বক্তব্যে।
পুঁজিবাজারে শৃঙ্খলা ফেরাতে আগের কমিশনগুলোর তুলনায় শিবলীর কমিশন অনেক বেশি উদ্যোগী, কিন্তু বাজারে গতি ফিরতে গিয়েও ফেরেনি। টানা ১৬ মাস চাঙ্গাভাবের পর গত এক বছর ধরে পতনের ধারা।
পুঁজিবাজারের এই চিত্রের জন্য যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কথা বলাবলি হচ্ছে, সেটি ভারতের ক্ষেত্রেও সত্য। ডলারের বিপরীতে সে দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে বাংলাদেশের সমানই। তবে সেখানে পুঁজিবাজার বাংলাদেশের মতো এভাবে ঝিমাচ্ছে না। এমনকি অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে যাওয়া শ্রীলঙ্কার বাজারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
শেয়ারের ক্রয়মূল্যে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা গণনার দাবি পূরণের পর দেশের পুঁজিবাজার নিয়ে দৃশ্যত আর বড় কোনো দাবি নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দীর্ঘ রক্ষণশীল মনোভাবেও এসেছে পরিবর্তন, কোম্পানিগুলোর সুশাসন নিশ্চিত করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পদক্ষেপও দৃশ্যমান, বন্ধ কোম্পানিগুলোকে আবার চালুর পদক্ষেপের পর উৎপাদনেও ফিরেছে অনেক কোম্পানি। আরও কিছু কোম্পানি উৎপাদনে আসার অপেক্ষায়।
গত ৩ অক্টোবর বিএসইসি কমিশনের হল রুমে ‘বিশ্ব বিনিয়োগ সপ্তাহ-২০২২’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখছেন বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। ফাইল ছবি
২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ধসের মধ্যে মিউচুয়াল ফান্ডগুলো লভ্যাংশ না দিলেও গত দুই বছরে ইউনিট-মূল্যের তুলনায় বেশ ভালো লভ্যাংশ দিচ্ছে। তবু বাজার নিয়ে যে আস্থার সংকটের কথা বলাবলি হচ্ছে একযুগ ধরে, সেটি ফিরছে না।
বিশ্ব বিনিয়োগ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সোমবার প্রসঙ্গটি ওঠে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ বলেন, ‘বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।'
এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে শিবলী রুবাইয়াত হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের শুনতে শুনতে কান ব্যথা হয়ে গেছে। আস্থা, এই আস্থা যে কোথা থেকে আনব সেটা আমরা বুঝি না।’
চেয়ারম্যানের এই বক্তব্যে যে প্রশ্নটি বড় হয়েছে, সেটি হলো আর কী হলে পুঁজিবাজারে আস্থা ফিরবে?
পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হতে সময় না লাগলেও সেটি ফেরাতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিনিয়োগ শিক্ষা বাড়ানো, সুশাসনের সঙ্গে ভালো কোম্পানিগুলোকে আইপিওতে আনার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে এটি ফেরানো সম্ভব।
‘শব্দটা ছোট, কিন্তু কাজটা কঠিন’
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আস্থা বা কনফিডেন্স শব্দটি ছোট, কিন্তু কাজটা অনেক কঠিন। আস্থা বলতে আমরা যা বুঝি- বিশ্বাস, মার্কেটের ওপর বিশ্বাস। বিএসইসি যা করেছে, সবই প্রশংসার দাবিদার। যেগুলো অতীতে হয়নি সেগুলোও করেছে কমিশন।
‘আস্থা আসে ওইখান থেকে, যেখানে প্রতিটি কমিটমেন্ট ঠিক থাকে। ধরা যাক, ডিভিডেন্ড দিলে ঠিকঠাক পায়, এজিএম ঠিকমতো করে, ভালো কোম্পানি লিস্টেড করে। আস্থা নিয়ে আসার জন্য এটি প্রথম কাজ।’
উদাহরণ তুলে ধরে শাকিল রিজভী বলেন, ‘ধরুন, ডিএসই মাছের বাজার বসিয়েছে। সেই বাজারের একটা কমিটি আছে, তারা সেভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে। আর সিটি করপোরেশনকে বিএসইসি বিবেচনা করুন, মানে তারা তদারকি করে। এখন এই কাঁচাবাজারে মানুষের আস্থা তৈরি করতে হলে কী কী করা দরকার?’
নিজের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তিনি বলেন, ‘গাড়িটা সুন্দরভাবে পার্ক করতে দিতে হবে, সবাই যাতে শৃঙ্খলভাবে থাকে। এই ধরনের কাজগুলো বিএসইসি করেছে, ঠিক করেছে।
কিন্তু যে মাছগুলো বিক্রি হচ্ছে সেগুলোর কী অবস্থা তা বিবেচনা করতে হবে। যদি পচা মাছ কিনে বাড়ি ফেরেন তাহলে কি আস্থা ফিরবে?
‘যতই লাইট দেয়া হোক, ঝকঝকে বাজার রাখা হোক। প্রোডাক্ট যদি ভালো না হয়, হবে না। যত ভালো কোম্পানি বাজারে আসবে তত আস্থা বাড়বে। অন্য বিষয়গুলো তো বাস্তবায়ন হয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘ভালো কোম্পানি সংযোজন করতে হবে। আজকে একটি ভালো কোম্পানি লিস্টেড হলেও কাল সবাই আস্থা ফিরে পাবেন- এমনটি নয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।’
তাহলে কি আস্থা ফিরবে না?- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আস্থা ফেরাতে সময় লাগবে, এক বছর, দুই বছর বা তারও বেশি লাগতে পারে। একবার আস্থা চলে গেলে তা ফেরানো খুবই কষ্টসাধ্য, কিন্তু আস্থা ফেরার পরে তা চলে যেতে সময় লাগে না।’
শাকিল রিজভী জোর দেন কোম্পানিগুলোর প্রতিবেদনের সত্যতার ওপর। বলেন, ‘যে কোম্পানিগুলো লিস্টেড হবে সেগুলো যেন ফেইক ইনফরমেশন, ফেইক অডিটেড রিপোর্ট দিয়ে লিস্টেড না হয়। সিকিউরিটিজের দর কমতে বা বাড়তে পারে, কিন্তু কোম্পানির কাছ থেকে যেন না ঠকেন বিনিয়োগকারীরা। তারা যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাজারে আসবে সেগুলোর বাস্তবায়ন যেন হয়। এসব যত ভালোভাবে করা যাবে, আস্থা সেভাবে ফিরে আসবে।’
বিএসইসির বারবার নীতিগত সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের সমালোচনা করেন শাকিল রিজভী। বলেন, ‘ছোটখাটো আইন পরিবর্তন বা সংস্করণ ঠিক আছে। কিন্তু খেলা চলছে, এর মধ্যে একবার বলা হলো প্রতি দলে ১২ জন খেলবে, একবার বলা হলো ১১ জন আবার একবার ৯ জন নিয়ে খেলা হবে বলে ঘোষণা দিলে কীভাবে হবে।’
‘আমাদের শুনতে শুনতে কান ব্যথা হয়ে গেছে। আস্থা, এই আস্থা যে কোথা থেকে আনব, সেটা আমরা বুঝি না।’
ফ্লোর প্রাইস আশীর্বাদ নাকি সংকট
পুঁজিবাজার যখন ক্রমেই নিচের দিকে নামছিল, তখন ২৮ জুলাই দ্বিতীয়বারের মতো ফ্লোর প্রাইস দেয় বিএসইসি। সব কোম্পানির শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বেঁধে দেয়ার পর ৩১ জুলাই থেকে সূচক বাড়তে শুরু করে।
এই দুই মাসে সূচক বেড়েছে প্রায় ৬০০ পয়েন্ট, তবে তাতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস নেই। কারণ ৩০ থেকে ৪০টি কোম্পানির দর বেড়েছে, আর ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে পৌনে দুই শটির বেশি কোম্পানি। এর মধ্যে আছে ডিএসই-৩০ এর আট থেকে ১০টি কোম্পানি।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও মনে করেন ফ্লোর প্রাইস বহু কোম্পানির লেনদেনে বাধা তৈরি করেছে। তিনি বলেন, ‘এতগুলো শেয়ার যদি ফ্লোর প্রাইসে পড়ে থাকে তাহলে মার্কেটটা জাজমেন্ট করবেন কীভাবে?
‘প্রথম থেকেই বলছি, আমি ফ্লোর প্রাইসের বিরোধী। মার্কেটকে স্বাভাবিকভাবে চলতে দিতে হবে। ফ্লোর প্রাইস না থাকলে হয়তো ইনডেক্সটা পাঁচ হাজার সাত বা আট শর নিচে নেমে যেত। কিন্তু পরে ঠিকই ব্যাক করে নিজের জায়গাটা খুঁজে নিত। নিজেই নিজের বায়ার করে নিত।’
‘এখন এতগুলো আইটেম ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর এই বাজারে কনফিডেন্স কীভাবে আসবে?’- বলেন ডিবিএ সভাপতি।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা কি যথাযথ ভূমিকা রাখছেন?
এই প্রশ্নটি উঠছে পুঁজিবাজার বিশ্লেষকদের পক্ষ থেকেই। তারা বলছেন, শক্তিশালী মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারে আগ্রহ নেই, আর দুর্বল কোম্পানির শেয়ারে বছরের পর বছর ধরে মাতামাতি চলছে- এই বিষয়টি হয়ে আসছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের আচরণের কারণে। তারাও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতো ডে ট্রেডারের ভূমিকা পালন করছে- এমন বক্তব্য আসছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকেই।
তবে ডিবিএ সভাপতি বলেন, ‘এটা আমি মনে করি না।’
তিনি বলেন, ‘মুখে পলিথিন দিয়ে যদি বলা হয় ভাত খেতে, আপনি পারবেন? তিন হাজার ৯৮০ পয়েন্টের সময় যা করা হয়েছে তা সব সময়েই করা ঠিক হবে না। ইনডেক্সকে পড়তে দিতে হবে। অযাচিতভাবে শেয়ারের রেট বাড়িয়ে দিলে সেটা কমতে হবে, কমিয়ে দিলে সেটা বাড়তে হবে।’
ফ্লোর প্রাইসে নতুন আইপিও বন্ধ রাখার পরামর্শ
আর কী প্রয়োজন আস্থা ফেরাতে? এই প্রশ্নের উত্তরে রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, ‘কোনটা হলে কী হতো বলা যায় না। এ রকম একটা বাজারে, যেখানে এতগুলো শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আছে, সেখানে এখন এত আইপিও বাজারে দরকার নাই।
‘ফ্লোর প্রাইস দিয়েছেন মানে বায়ার নাই বা ডিমান্ড কম, আবার আইপিও নিয়ে আসছেন।
বলছেন ডিমান্ড নাই আবার সাপ্লাই বাড়াচ্ছেন। এটা সাংঘর্ষিক। আমি আইপিওর পক্ষে, ভালো আইপিও আসুক। বাজারে এনভায়রনমেন্ট ওকে করে নিয়ে ভালো আইপিও নিয়ে আসা হোক।’
তিনি বলেন, ‘কারণ বাজারের আকার বড় করতে হবে। এই বাজারে ৫০০ কোটি টাকা ইন করলে বের করা যায় না। এ জন্য অনেকেই আসে না। এটা যখন হবে তখন সবাই আসবে।’
বিনিয়োগ শিক্ষার তাগিদ
আস্থা ফেরাতে বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছেন ঢাকা ব্যাংক সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাফিজ-আল-তারিক।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের শিক্ষা বাড়ানো দরকার। রেজিস্টার্ড ফিন্যানশিয়াল অ্যাডভাইজার দরকার, যারা বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ বিষয়ে আস্থা বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিএসইসি যা করছে, সেটা ভালো। সামনে বাজারে বন্ড আসছে। আমরা ঠিক পথে আছি। সময় লাগবে। আর কিছু ম্যাক্রো-ইকোনমিকস ফ্যাক্ট আছে ওয়ার্ল্ডওয়াইড। সেগুলো তো আর রেগুলেটরের নিয়ন্ত্রণে না। এই মুহূর্তে কিছুই চাওয়ার নাই। যেভাবে আগাচ্ছে, সবাই সহযোগিতা করলে এগিয়ে যাবে আশা করি।’
পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট এই কর্মকর্তা বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির কারণে শুধু আমাদের পুঁজিবাজারে প্রভাব পড়ছে, তা নয়। বিশ্বব্যাপী এর নেতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান। সময়টাই খারাপ যাচ্ছে, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।’