বেলা একটা ৩৮, লেনদেন শেষ হতে বাকি আরও ১২ মিনিট। সে সময় ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকোর ৮ লাখ ৭ হাজার ১৪৮টি শেয়ারের বিক্রেতা থাকলেও ক্রেতার ঘর শূন্য।
এই কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে সেরা কোম্পানির একটি হিসেবে বিবেচিত, যার প্রতি বছর আকর্ষণীয় প্রবৃদ্ধি এবং দারুণ লভ্যাংশ দেয়া হয়।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সেরা ৩০টি কোম্পানি মিলিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ এর একটি এই ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো।
কিন্তু গত মাস দুয়েক ধরে কোম্পানিটির ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না, যে অবস্থা ডিএসই-৩০ এর আরও অনেক কোম্পানির।
সপ্তাহের তৃতীয় কর্মদিবস মঙ্গলবার সূচক অনেকখানি বাড়লেও বিপুল সংখ্যক কোম্পানির ক্রেতা না থাকার বিষয়টি আবার দেখা যায়। এর মধ্যে ডিএসই-৩০ এর ৮টি কোম্পানি রয়েছে।
এর মধ্যে ছিল ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে শক্তিশালী কোম্পানির একটি ব্র্যাক ব্যাংক। বেলা একটা ৪১ মিনিটে কোম্পানিটির ৬৫ লাখ ৮৪ হাজার ৩৮৭টি শেয়ারের বিক্রয়াদেশের বিপরীতে ক্রেতা ছিল না একটিওর।
বেঁধে দেয়া সর্বনিম্ন দর বা ফ্লোর প্রাইসে ৩৩ হাজার ৯০০টি শেয়ারের ক্রেতা ছিল ইস্টার্ন ব্যাংকের।
গত দুই বছরে পুঁজিবাজারে তোলপাড় তোলা ফরচুন সুজের ২৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৭টি কোম্পানির বিক্রয়াদেশের বিপরীতে ক্রেতা ছিল না একটির।
লেনদেন শেষ হওয়ার দুই মিনিট আগে প্রতি বছর সবচেয়ে বেশি মুনাফা করা ইসলামী ব্যাংকের ১৩ হাজার ৪৫১টি শেয়ারের ক্রেতা দেখা গেছে।
পুঁজিবাজারে একক কোম্পানি হিসেবে সবচেয়ে বেশি লভ্যাংশ দেয়া গ্রামীণ ফোনেরও ক্রেতা ছিল না। কিন্তু ১ লাখ ৮৮ হাজার ৩৬৯টি শেয়ার বিক্রির চেষ্টা করছিলেন বিক্রেতারা।
লেনদেন শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের ২২ লাখ ৯১ হাজার ২০৮টি, রেনাটার ৩৭ হাজার ৫৪০টি আর, রবির ৩৪ লাখ ১৬ হাজার ২৭৮টি, সিঙ্গার বিডির ৩ হাজার ৩৩১টি আর স্কয়ার ফার্মার ৩ লাখ ৮০ হাজার ৭৫টি শেয়ার বিক্রির আদেশ ছিল। কিন্তু ক্রেতা ছিল না একটিরও।
পুঁজিবাজারে গত দুই মাসে সূচক ১০ শতাংশের মতো বাড়লেও আসলে বাজারে কী হচ্ছে, তার একটি উদাহরণ এটির। ডিএসইর সেরা ৩০ কোম্পানির মধ্যে আটটি দিনভর ক্রেতা শূন্য থাকার মধ্যে কেউ কেউ মাঝে মধ্যে কিছু শেয়ার কিনেছে। আর যেগুলো ডিএসই-৩০ এর বাইরে, সেগুলোর কথা বলাই বাহুল্য।
৩৭টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে সেপ্টেম্বরে অর্থবছর শেষ করা এলআর গ্লোবাল ওয়ানের কেবল বলার মতো কিছু লেনদেন হয়েছে। কোনো কোনোটির একটিও না, কোনো কোনোটির নামকাওয়াস্তে ইউনিট হাতবদল হয়েছে।
এদিন সূচক বাড়লেও আবার বেশিরভাগ শেয়ারের দরপতনের চিত্র দেখা গেছে। বেড়েছে ৭৭টির দর, কমেছে ১১২টির, আগের দিনের দরে হাতবদল হয়েছে ১৮০, যেগুলোর সিংহভাগই বেঁধে দেয়া সর্বনিম্ন দর বা ফ্লোর প্রাইসে লেনদেন হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিপুল সংখ্যকের কোনো ক্রেতা দেখা যায়নি।
মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সূচক কিছুটা বাড়লেও বেশিরভাগ কোম্পানি দর হারিয়েছে
লেনদেন হয়েছে এক হাজার ২৯০ কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা, যা আগের দিনের তুলনায় কিছুটা বেশি। সোমবার ১৩ পয়েন্ট সূচক পতনের দিন হাতবদল হয় ১ হাজার ২৮৪ কোটি ৭৩ লাখ ৭২ হাজার টাকা।
ফের ওরিয়নের রাজত্ব
বাজারে এই চিত্রের মধ্যে গত কয়েকদিন ধরে কিছুটা ঝিমাতে থাকা ওরিয়ন গ্রুপের চার কোম্পানির শেয়ারের দামে লাফ দেখা গেছে। দাম বেড়েছে বেক্সিমকো লিমিটেডেরও। আর এই পাঁচ কোম্পানির ওপর ভর করে সূচক বেড়েছে অনেকটাই।
দিন শেষে যে ২৬.৪৮ পয়েন্ট সূচক বেড়েছে, তার মধ্যে ওরিয়ন গ্রুপের বিকন ফার্মা একাই যোগ করেছে ১৭.৫৩ পয়েন্ট। একই গ্রুপের ওরিয়ন ফার্মা ৬.১৩ পয়েন্ট, কোহিনূর কেমিক্যালস ৩.১১ পয়েন্ট এবং ওরিয়ন ইনফিউশন বাড়িয়েছে ২.৬৯ পয়েন্ট।
অন্যদিকে বেক্সিমকো গ্রুপের বেক্সিমকো লিমিটেড বাড়িয়েছে ৪.২৬ পয়েন্ট।
অর্থাৎ এই পাঁচ কোম্পানিই সূচকে যোগ করেছে ৩৩.৭২ পয়েন্ট।
এসব কোম্পানির মধ্যে বিকন ফার্মার দর বেড়েছে ৮.৭২ শতাংশ। আগের দিন দর ছিল ৩২২ টাকা ২০ পয়সা। এখন দাঁড়িয়েছে ৩৫০ টাকা ৩০ পয়সা।
মঙ্গলবার সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি পাওয়া ৬টি কোম্পানির চারটিই ওরিয়ন গ্রুপের
কোহিনূর কেমিক্যালসের দর বেড়েছে ৭.৪৯ শতাংশ। আগের দিন দর ছিল ৬০১ টাকা ৪০ পয়সা। বেড়ে হয়েছে ৬৪৬ টাকা ৫০ পয়সা।
ওরিয়ন ইনফিউশনের দর বেড়েছে ৭.৪৯ শতাংশ। আগের দিন দর ছিল ৬৫২ টাকা ৫০ পয়সা, বেড়ে হয়েছে ৭০১ টাকা ৪০ পয়সা।
ওরিয়ন ফার্মার দর বেড়েছে ৭.২৩ শতাংশ। আগের দিন দর ছিল ১৩৪ টাকা, বেড়ে হয়েছে ১৪৩ টাকা ৭০ পয়সা।
সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি পাওয়া ১০ কোম্পানির মধ্যে একই গ্রুপের এই চারটি কোম্পানি ছিল।
এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে চার মাসেরও কম সময়ে ওরিয়ন ইনফিউশনের দর আট গুণের বেশি বেড়েছে।
বেক্সিমকো লিমিটেডের দর বেড়েছে ৩.৮৪ শতাংশ। আগের দিন দর ছিল ১৩০ টাকা ১০ পয়সা, বেড়ে হয়েছে ১৩৫ টাকা ১০ পয়সা।
একটি কোম্পানি লেনদেন ২০০ কোম্পানির চার গুণ
এদিন যথারীতি লেনদেনের শীর্ষে ছিল ওরিয়ন ফার্মা। আগের কর্মদিবসে দরপতনের দিন লেনদেন এক শ কোটি টাকার নিচে নামলেও দর বাড়ার পর আবার লাফ দিয়ে হাতবদল হয়েছে ১৫২ কোটি ৮৪ লাখ ৩০ টাকার।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে বেক্সিমকো লিমিটেডে। হাতবদল হয়েছে ১২১ কোটি ৯৩ লাখ ৮৯ হাজার টাকার।
এই শীর্ষ দুই কোম্পানির লেনদেন ৩০০টি কোম্পানির সম্মিলিত লেনদেনের চেয়ে বেশি।
এই দুই কোম্পানিতে হাতবদল হয়েছে ২৭৪ কোটি ৭৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা। অন্যদিকে হাতবদল হওয়া ৩৭৪টি কোম্পানির মধ্যে ৩০০টি মিলিয়ে লেনদেন হয়েছে ২৫১ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
অন্যদিকে সবচেয়ে কম লেনদেন হওয়া ১০০টি কোম্পানিতে মিলিয়ে হাতবদল হয়েছে ৫ কোটি ৮৮ লাখ। ২০০টি কোম্পানি মিলিয়ে হাতবদল হয়েছে ৩৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যা ওরিয়নের লেনদেনের ২৪ শতাংশ মাত্র।
ফ্লোর প্রাইসকে দোষারোপ
পুঁজিবাজারের লেনদেনের এই চিত্র নিয়ে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও বলেন, ‘ফ্লোর প্রাইসের কারণেই ক্রেতা সংকট দেখা দিয়েছে। এর কারণে অনেক শেয়ারের দাম কমতে পারছে না। একটা রিজনেবল প্রাইসে শেয়ার কিনতে না পারলে নতুন বিনিয়োগ করবে কীভাবে?
‘কোনো শেয়ারের দর যদি বেশি কমে যায়, সেটি পুনরায় তার জায়গায় চলে আসবে। এজন্য এটাকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। মার্কেটে যে বিনিয়োগ, তা এমন নয় যে, নতুন করে ফান্ড ঢুকছে, বিনিয়োগকারীরা একটা বিক্রি করে আরেকটা কিনছেন।’
বাজার পরিস্থিতি নিয়ে ট্রেজার সিকিউরিটিজের শীর্ষ কর্মকর্তা মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘কিছু শেয়ারের ওপর নির্ভর করে ইনডেক্স মুভ করছে। আবার টার্নওভারও ভালো। বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে বলা যায় সামনে একটা মুভমেন্ট আসতে পারে। মার্কেটের যে সেট-আপ তা নতুন পোলারাইজেশনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই রকম পরিস্থিতি যখন আসে তার পরে একটা র্যালির সম্ভাবনা থাকে।’
বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার পরামর্শ দেন ডিএসইর এই ব্রোকার। বলেন, ‘বিপুল সংখ্যক শেয়ারের ক্রেতা নাই যেমন ঠিক, তেমনি একটা কথা রয়েছে- মার্কেট ইজ অলওয়েজ গুড। মার্কেট আমার মতো হবে না, আমার সাইকোলজির সঙ্গে নাও চলতে পারে। আমি কতটুকু মানিয়ে চলতে পারছি সেটাই বড় কথা। মার্কেটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।’
দরপতন-দরবৃদ্ধির হার কম
বড় খাতের মাত্র দুটিতে দরপতনের হার বেশি দেখা গেছে। এর মধ্যে প্রকৌশল খাতে ২২টি বা ৫৩.৩৮ শতাংশ ও খাদ্য খাতে ৯টি বা ৫২.৯৪ শতাংশ কোম্পানির দরপতন হয়েছে।
এ ছাড়া দরপতন বেশি ছিল সেবা ও আবাসন এবং সিরামিকস খাতে।
বিপরীতে কাগজ ও মুদ্রণ খাতের ৪টি বা ৬৬.৬৭ শতাংশ এবং ভ্র্রমণ ও অবকাশ খাতের তিনটি বা শতভাগ কোম্পানির দরবৃদ্ধি হয়েছে। আর কোনো খাতে দরবৃদ্ধির হার বেশি ছিল না।
দুই দিন পরে আবারও লেনদেনের শীর্ষস্থান দখল করেছে ওষুধ ও রসায়ন খাত। হাতবদল হয়েছে ২৬৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা, যা লেনদেনের ২১.৯৩ শতাংশ।
খাতের ১৪টি বা ৪৬.৬৭ শতাংশ কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে ৮টি করে কোম্পানির দর কমে ও অপরিবর্তিত থেকে লেনদেন হয়েছে।
বিবিধ খাতে লেনদেন হয়েছে ২১৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ৫টি করে কোম্পানির দরবৃদ্ধি ও দরপতন হয়েছে। ৩টির দর অপরিবর্তিত ছিল।শীর্ষ অবস্থান থেকে নেমে প্রকৌশল খাতে হাবদল হয়েছে ১৮৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। ১০টি করে কোম্পানির দরবৃদ্ধি ও অপরিবর্তিত ছিল। আর কমেছে ২২টি কোম্পানির দর।
৭৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা লেনদেনের মাধ্যমে চতুর্থ অবস্থানে চলে এসেছে সেবা ও আবাসন খাত। খাতের ৪টি কোম্পানির মধ্যে একটির দর বেড়ে ও তিনটির দর কমে লেনদেন হয়েছে।
এর পরেই কাগজ ও মুদ্রণ খাতের লেনদেন হয়েছে ৭৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। ৪টি কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে একটি করে কোম্পানির দরপতন ও অপরিবর্তিত ছিল।
এরপরে লেনদেনের ওপরের দিকে ছিল জ্বালানি, বস্ত্র, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও খাদ্য খাত।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
৮.৭২ শতাংশ দর বেড়েছে অ্যাপেক্স ফুডসের। শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২৪৫ টাকা ৪০ পয়সায়। আগের দিনে দর ছিল ২২৫ টাকা ৭০ পয়সা।
সমান দর বেড়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বিকন ফার্মা। ৩২২ টাকা ২০ পয়সা থেকে বেড়ে শেয়ারটি সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৩৫০ টাকা ৩০ পয়সায়।
মনোস্পুল পেপারের দর ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ বেড়ে শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২৪৫ টাকা ৭০ পয়সায়।
দরবৃদ্ধির তালিকায় ছিল কোহিনূর কেমিক্যাল, ওরিয়ন ইনফিউশন, ওরিয়ন ফার্মা, জুট স্পিনার্স, কে অ্যান্ড কিউ, পেপার প্রসেসিং ও এডিএন টেলিকম।
দর পতনের শীর্ষ ১০
পতনের তালিকার শীর্ষে দেখা গেছে কেয়া কসমেটিকসকে। ৬ দশমিক ০২ শতাংশ কমে প্রতিটি শেয়ার সর্বশেষ ৭ টাকা ৮০ পয়সায় লেনদেন হয়। আগের দিনে লেনদেন হয় ৮ টাকা ৩০ পয়সায়।
পরের স্থানে ছিল ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ দর কমে শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৬ টাকা ৬০ পয়সায়।
তৃতীয় সর্বোচ্চ দর হারিয়েছে বিডি ওয়েলডিং। ৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ কমে শেয়ারটি সর্বশেষ ২৫ টাকা ৭০ পয়সায় হাতবদল হয়। আগের দিনের দর ছিল ২৬ টাকা ৯০ পয়সায়।
এ ছাড়া দরপতনের তালিকায় ছিল বিডি থাই ফুড, আরএসআরএম স্টিল, দেশবন্ধু পলিমার, সোনারগাঁও টেক্সটাইল, কপারটেক, মীর আকতার হোসেন লিমিটেড ও ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড।