শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সব দেশের অর্থনীতির উদ্বেগজনক ও স্পর্শকাতর সূচক এখন মূল্যস্ফীতি। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠে ৯ শতাংশে পৌঁছেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার এখন কত- তা জানতে দুই মাস পেছনে যেতে হবে। কেননা, জুলাইয়ের পর মূল্যস্ফীতির কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো- বিবিএস।
গত জুলাইয়ে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এরপর আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস চলে গেছে, কিন্তু অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকের তথ্য প্রকাশ করেনি বিবিএস। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে সরকার লুকোচুরি করছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবের কারণে আগস্টে মূল্যস্ফীতি অনেকটা বেড়েছে বলে সেটা প্রকাশ করতে দেরি করা হচ্ছে। দেশে এমনটা অতীতে বিভিন্ন সরকারের সময়ে হয়েছে। তথ্য-উপাত্ত নিয়ে রাজনৈতিকীকরণ বন্ধ হওয়া উচিত। ‘কমলে প্রথম সপ্তাহে, বাড়লেই অপেক্ষার পর অপেক্ষা’- এই খারাপ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য সঠিক সময়ে প্রকাশ করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
তবে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া বা মূল্যস্ফীতি বাগে এসেছে বলে দাবি করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দেননি তিনি। মন্ত্রী বলেছেন, ‘চলতি বছরের আগস্টে মূল্যস্ফীতি অনেক বাড়লেও সেপ্টেম্বরে তা কমে এসেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে।’
সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি করেন এম এ মান্নান।
এক মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও আগস্টে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার কত ছিল, সে তথ্য এখনও প্রকাশ করেনি পরিসংখ্যান ব্যুরো। সেপ্টেম্বরে তা কমে কততে নেমেছে সে তথ্যও প্রকাশ করেনি বিবিএস। পরিকল্পনামন্ত্রীও এই দুই মাসের তথ্য প্রকাশ করেননি।
মন্ত্রী সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের জন্য ভালো সংবাদ আছে। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া বাগে এসেছে এই মাসে (সেপ্টেম্বর)। সবাই আমাদের কাছে ফোন করে জানার জন্য। গত মাসে (আগস্ট) মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল।
‘এই মাসে নেমেছে এবং ভালোভাবে নেমেছে। আমি যদিও অর্থনীতিবিদ নই, তবুও আমি বলছি আগামী মাসে (অক্টোবর) মূল্যস্ফীতি আরও কমবে।’
মূল্যস্ফীতি কমার কারণ ব্যাখ্যা করে মন্ত্রী বলেন, ‘কেন কমেছে? কারণ আমাদের সরকারের কৌশলগত ব্যবস্থা। তেলের দাম বেড়েছিল, কিন্তু এখন কমেছে। কারণ এক কোটি কার্ড বিতরণ করা হয়েছে। সেখানে কম দামে বিক্রি হচ্ছে চাল, তেল।
‘ফলে আমরা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরাসরি আঘাত করতে পেরেছি। এতে দাম কমে এসেছে। শুধু কমেনি; ভালো কমেছে। বিশ্ববাজারেও কমেছে। কয়েক দিনের মধ্যে আপনারা মূল্যস্ফীতির পুরোটা তথ্য পেয়ে যাবেন।’
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বড় ধরনের মূল্যস্ফীতি হয়েছে বাংলাদেশে। চলতি বছরের জুনে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয় ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরের মাস জুনে সেটি সামান্য কমে হয় ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এরই মধ্যে দুই মাস পার হয়ে গেছে, কিন্তু আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের তথ্য প্রকাশ করেনি বিবিএস।
মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে লুকোচুরি কেন?
সাধারণত প্রথম সপ্তাহেই আগের মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে থাকে পরিসংখ্যান ব্যুরো। সেই ধারাবাহিকতায় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে আগস্ট মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য তৈরি করে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয় বিবিএস। কিন্তু সরকারের উচ্চপর্যায়ের ‘সবুজ সংকেত’ পাওয়া যায়নি। ফলে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকটির আগস্ট মাসের তথ্য প্রকাশ করেনি পরিসংখ্যান ব্যুরো। এরই মধ্যে সেপ্টেম্বর মাসও শেষ হয়ে গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিএসের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মাঠ পর্যায় থেকে যে তথ্য পাই, তা দিয়ে মূল্যস্ফীতির হিসাব কষে মাসের দুই-তিন তারিখের মধ্যেই অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠাই। মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয়ার সেই তথ্য আমরা প্রকাশ করি। আগস্ট মাসের তথ্য এখনও অনুমোদন দেয়নি মন্ত্রণালয়। সে কারণে আমরাও প্রকাশ করতে পারছি না।’
বিবিএস সূত্রে জানা গেছে, পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে গত আগস্ট মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আর খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে উঠেছে। এক মাসের মধ্যে প্রায় ৩ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির তথ্য সরকার প্রকাশ না করলেও সীমিত আয়ের মানুষ ঠিকই এর উত্তাপ পাচ্ছে।
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত তথ্য নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন উঠেছে। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বেশি হারে বেড়েছে বলেই মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। অর্থনীতির তথ্য-উপাত্ত নিয়ে এক ধরনের রাজনীতি করা হচ্ছে বলে আগের মতোই অভিযোগ করেছেন তারা।
গত মার্চ মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বলেছিল, পরিসংখ্যান ব্যুরো দেশে মূল্যস্ফীতির যে তথ্য প্রকাশ করে, প্রকৃত হার তার দ্বিগুণের চেয়ে বেশি। সানেম ওই সময় বলেছিল, শহর এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। গ্রামে এই হার ১২ দশমিক ১০ শতাংশ।
আরেক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যও ওই সময় বলেছিলেন, দেশে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি বিবিএসের তথ্যের দ্বিগুণেরও বেশি।।
সে সময় বিবিএসের তথ্যে বলা হয়েছিল, ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৬ দশমিক ১২ শতাংশ।
আগস্ট মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে নীতিনির্ধারক, অর্থনীতিবিদ, গবেষকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ আগ্রহ ছিল। কারণ, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
কয়েক মাস ধরেই দেশে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির প্রবণতা ছিল। আবার তখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামও কিছুটা কমেছিল। ঠিক এ রকম এক সময়ে, গত ৫ আগস্ট সরকার জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা, অকটেনের দাম লিটারে ৪৬ টাকা ও পেট্রলের দাম লিটারে ৪৪ টাকা বাড়ানো হয়। এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক লাফে জ্বালানি তেলের দাম এত বাড়ানো হয়নি।
এর পরপরই সব ধরনের পরিবহন ভাড়া বাড়ানো হয়। এই দুইয়ের প্রভাবে বেড়ে যায় প্রায় সব পণ্যের দাম। এরপর গত ২৯ আগস্ট খানিকটা মুখ রক্ষা করতে জ্বালানি তেলের দাম ৫ টাকা কমায় সরকার। তবে তাতে বাজারে খুব একটা প্রভাব দেখা যায়নি; বরং এর সামগ্রিক প্রভাবে খাদ্যপণ্য ছাড়াও যাতায়াত, পোশাক-আশাক, শিক্ষাসামগ্রীসহ খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দামও বেশ বেড়ে যায়। সুতরাং তখন থেকেই আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধির শঙ্কা করা হচ্ছিল। একাধিক অর্থনীতিবিদের প্রাক্কলন ছিল মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এ নিয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যখন মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশে দেরি হয়, তখন সরকারের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সাধারণত প্রথম সপ্তাহেই মূল্যস্ফীতির তথ্য তৈরি হয়ে যায়। তাহলে দুই মাস পার হয়ে গেলেও দেশবাসী মূল্যস্ফীতির কোনো তথ্য পাচ্ছে না কেন? তথ্য-উপাত্ত নিয়ে রাজনৈতিকীকরণ বন্ধ হওয়া উচিত। কারণ, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে নীতি ঠিক করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কারসাজি করা হচ্ছে, তথ্য ঢেকে রাখা হচ্ছে। ৯-১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি যা-ই হোক না কেন, এটা প্রকাশ করা উচিত। বিভিন্ন দেশ তাদের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে ফেলছে।’
তার মতে, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আরও ৩ শতাংশের মতো মূল্যস্ফীতি বাড়বে।
গত কয়েক মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশের সময়কাল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কোনো মাসের মূল্যস্ফীতি কমলে পরের মাসের প্রথম সপ্তাহেই তা প্রকাশ করা হয়। আবার বাড়লে মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশে পরের মাসের তৃতীয় বা চতুর্থ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
যেমন গত মে ও জুন মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৭ শতাংশের বেশি ছিল। মে মাসে ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং জুন মাসে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ওই দুই মাসের তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয় পরের মাসের ১৯ তারিখে। আবার গত জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ হয়। আর জুলাই মাসের মূল্যস্ফীতির সেই তথ্য প্রকাশ করা হয় দ্রুতগতিতে, আগস্ট মাসের ৩ তারিখে।
দেশের প্রায় সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করার একমাত্র সংস্থা বিবিএস। আট-দশ বছর আগে বিবিএস আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করত। বিবিএসের পরিবর্তে এখন পরিকল্পনামন্ত্রী নিজে মূল্যস্ফীতির তথ্য সাংবাদিকদের জানান। মূলত বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালই পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে নিজেই মূল্যস্ফীতির তথ্য সাংবাদিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে শুরু করেছিলেন।
আবার ২০১৭ সালে মূল্যস্ফীতি টানা বাড়তে থাকলে আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রতি মাসের পরিবর্তে তিন মাস পরপর মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করলে আবারও মাসিক ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি প্রকাশ শুরু হয়েছিল।
মূল্যস্ফীতি এখন সারা বিশ্বেরই সবচেয়ে বড় সমস্যা। বিশ্বব্যাপী সব ধরনের অর্থনৈতিক নীতি নেয়া হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ বা ফেড মূল্যস্ফীতি কমাতে আগ্রাসীভাবে নীতি সুদের হার বাড়াচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে মন্দাকে পর্যন্ত ডেকে আনা হচ্ছে।
এ নিয়ে এখন বিশ্বব্যাপী চলছে প্রবল বিতর্ক। বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, সবাই যদি সমন্বিতভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কাজটি না করে, তাহলে মন্দার চেয়েও খারাপ অবস্থা হতে পারে। দেখা দিতে পারে স্ট্যাগফ্লেশন বা বদ্ধস্ফীতি। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি আদৌ কমল না, অথচ প্রবৃদ্ধি কমে গেল ভয়াবহভাবে।
‘এ পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতির সঠিক তথ্য প্রকাশ করা উচিত’ মন্তব্য করে অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির তথ্য দিয়ে নীতি ঠিক করা দরকার। মূল্যস্ফীতির তথ্য না থাকলে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব কীভাবে। আমানত ও ঋণের সুদের হার মূল্যস্ফীতি দিয়ে ঠিক করা উচিত। মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা আনতেও মূল্যস্ফীতির সঠিক তথ্য দরকার।’