নো ডিভিডেন্ড ঘোষণার পর পড়তির দিকে থাকা শেয়ারদর তরতর করে বাড়তে থাকে এজিএমে এক শতাংশ লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্তে। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে শেয়ারদর ৫০ শতাংশ বেড়েও যায়। তবে সেই লভ্যাংশ আর বিতরণ করা হয়নি।
এই কাণ্ড করেছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। ২০২১ সালের জুনে সমাপ্ত অর্থবছরের লভ্যাংশ ঘোষণার পর এই কাণ্ড করেছে তারা। আগের বছরেও একই কাজ করেছে কোম্পানিটি।
ঘোষিত লভ্যাংশ বিতরণ করে যে প্রতিবেদন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসইতে দেয়ার কথা ছিল, সেটি জমা দেয়া হয়নি। বিষয়টি অবহিত করে নির্দেশনা চেয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি।
অভিযোগ উঠেছে, লভ্যাংশ সংক্রান্ত এসব ঘোষণা দিয়ে শেয়ারদর বাড়িয়ে কোম্পানির কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হচ্ছেন। এ নিয়ে যোগাযোগ করা হলে কোম্পানির পক্ষ থেকে বক্তব্য দেয়ার জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি।
নো ডিভিডেন্ডের সিদ্ধান্ত পাল্টানোর পর শেয়ারদরে লাফ
২০২১ সালের জুনে সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য কোম্পানিটি নো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করলেও গত ২৩ ডিসেম্বর বার্ষিক সাধারণ সভা বা এজিএমে সে প্রস্তাব বাতিল করে ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করে।
কিন্তু সেই লভ্যাংশ বিতরণ করার কোনো সিদ্ধান্ত আর জানানো হয়নি।
২০২১ সালের ১১ নভেম্বর কোম্পানিটি লভ্যাংশ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার দিন শেয়ারদর ছিল ১১ টাকা ১০ পয়সা। পরিচালনা পর্ষদের এই সিদ্ধান্তের পর শেয়ারদর কমে আসে ৯ টাকা ৫০ পয়সা।
এজিএমের দিন শেয়ারদর ছিল ১০ টাকা ২০ পয়সা। লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণা পাল্টানোর সিদ্ধান্ত আসার পর শেয়ারদর আবার দেয় লাফ। ১২ কর্মদিবস পর ১০ জানুয়ারি শেয়ারদর বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ টাকা ৬০ পয়সা। এই সময়ে বাড়ে ৪ টাকা ৪০ পয়সা বা ৪৩ দশমিক ১৩ শতাংশ।
যে কোম্পানিটির ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে যাওয়ার কথা ছিল, লভ্যাংশ দেয়ার সিদ্ধান্তের কারণে সেটি আর সেই ক্যাটাগরিতে না গিয়ে ‘বি’তে লেনদেন হতে থাকে।
বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে জানান, বিধান হলো এজিএমে লভ্যাংশ অনুমোদনের ৩০ দিনের মধ্যে তা বিনিয়োগকারীর হিসাবে পাঠাতে হবে। লভ্যাংশ শেয়ারে দেয়ার সিদ্ধান্ত হলে তা পাঠাতে হয় বিও হিসাবে আর নগদে হলে দিতে এখন সরাসরি ব্যাংক হিসাবে পাঠাতে হয়। আর যদি বিনিয়োগকারী মার্জিন ঋণ নিয়ে শেয়ার কিনে থাকেন, তাহলে নগদ লভ্যাংশও যাবে বিনিয়োগকারীর বিও হিসাবে।
কিন্তু এজিএমের ১০ মাসেও পর্যন্ত লভ্যাংশ বিতরণ সংক্রান্ত কোনো বিজ্ঞপ্তি শেয়ারধারীদেরকে জানানো হয়নি।
আগের বছর একই চিত্র
২০২০ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য ৩ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। এর মধ্যে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ নগদ ও বাকি ২ দশমিক ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার। অর্থাৎ প্রতি ২০০ শেয়ারের বিপরীতে পাঁচটি বোনাস শেয়ার ও ১০ পয়সা নগদ বিতরণ করা হয়।
ওই বছরের ২৯ ডিসেম্বর এজিএমে সেই লভ্যাংশ অনুমোদনও হয়। কিন্তু সে বছরও লভ্যাংশ বিতরণ করে কোনো প্রতিবেদন দেয়া হয়নি।
পরিচালনা পর্ষদ লভ্যাংশ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত জানানোর দিন শেয়ারদর ছিল ১১ টাকা ৫০ পয়সা। পরের বছর ৫ আগস্ট দর বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ টাকা।
কোম্পানিটি ২০২১ সালের জুনে সমাপ্ত অর্থবছরের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর এখন পর্যন্ত কোনো প্রান্তিক প্রতিবেদনও প্রকাশ করেনি। অথচ এরই মধ্যে আরও একটি অর্থবছর শেষ হয়ে গেছে। জুনে যেসব কোম্পানির অর্থবছর শেষ হয়, সেগুলোর মধ্যে বেশ কিছু কোম্পানি তাদের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে লভ্যাংশও ঘোষণা করেছে, হাতে গোনা এক দুইটি বাদ দিয়ে বাকিগুলো মার্চে সমাপ্ত তৃতীয় প্রান্তিকের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কয়েক মাস আগেই।
ডিএসইর চিঠিতে যা বলা হয়েছে
বিএসইসিতে পাঠানো ডিএসইর চিঠিতে বলা হয়, ডিএসইর ২০১৫ সালের রেগুলেশনস অনুযায়ী- তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে এক্সচেঞ্জ ও বিএসইসিতে লভ্যাংশ প্রদান সংক্রান্ত প্রতিবেদন সাতদিনের মধ্যে কমিশন নির্ধারিত ফরম্যাটে জমা দিতে হবে।
এর ব্যত্যয় ঘটলে সেই কোম্পানিকে কমিশনের অনুমোদনক্রমে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করার বিধান রয়েছে। কিন্তু ওয়েস্টার্ন মেরিন দুই বছর ধরে ডিভিডেন্ড কমপ্লায়েন্স রিপোর্ট জমা না দেয়ার পরও তাদের ‘ক্যাটাগরি’ সমন্বয় হয়নি।
ডিএসইর ওয়েব সাইট দেয়া কোম্পানির যোগাযোগ নম্বরে ফোন করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
নিউজবাংলা ডিএসইর চিঠিটি পেলেও সংস্থাটির মুখপাত্র ও উপ-মহাব্যবস্থাপক শফিকুর রহমান বলেন, ‘চিঠির বিষয়টি আমার জানা নেই। না জেনে কিছুই বলতে পারব না।’
ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সাইফুর রহমান মজুমদারের ফোনে কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
পুঁজিরবাজারে তালিকাভুক্ত ওয়েস্টার্ন শিপইয়ার্ডের অনুমোদিত মূলধন ৬০০ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন ২৩৫ কোটি ২০ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এর বিপরীতে রিজার্ভ রয়েছে ২৬১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ার সংখ্যা ২৩ কোটি ৫২ লাখ ৩ হাজার ৭৬৯টি। এর মধ্যে ৩০ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালক, ১৬ দশমিক ১৪ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও বাকি ৫৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে।