এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ লেনদেনের রেকর্ড গড়ার চার দিনের মাথায় পুঁজিবাজারে শেয়ার কেনাবেচার গতি অর্ধেকে নেমে এসেছে।
গত ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন হয়েছিল ২ হাজার ৮৩২ কোটি ৩০ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। গত এক বছরে এর চেয়ে বেশি লেনদেন কখনও হয়নি। ২০১০ সালে মহাধসের পর এর চেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে মোট সাত কর্মদিবসে।
চার কর্মদিবস পর সোমবার এই লেনদেন দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩০০ কোটি ১৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
তবে লেনদেনের রেকর্ডের দিন যারা শেয়ার কিনেছেন, তারা বিক্রি করতে গিয়ে এখন গলদঘর্ম হচ্ছেন। কারণ ক্রেতা নেই। কয়েকটি কোম্পানির শেয়ার ঘিরে অস্বাভাবিক হুলুস্থুলের কারণে সূচক ও লেনদেন ক্রমাগত বাড়তে থাকার যে প্রবণতা দেখা দিয়েছিল, তা এরই মধ্যে গতি হারিয়েছে।
বিশেষ করে ওরিয়ন গ্রুপের চারটি ও বেক্সিমকো গ্রুপের মোট ছয়টি কোম্পানির দুরন্ত গতি থেমে যাওয়ার পর এই চিত্র দাঁড়িয়েছে।
২০ সেপ্টেম্বর বেক্সিমকো লিমিটেডের ৩৪২ কোটি টাকার বেশি আর ওরিয়ন ফার্মার ৩২৭ কোটি টাকার বেশি। চার কর্মদিবস পর সোমবার ওরিয়ন ফার্মায় লেনদেন হয়েছে ১১৫ কোটি টাকার কিছু বেশি আর বেক্সিমকো লিমিটেডে ১১৪ কোটি টাকার কিছু বেশি।
ওরিয়ন ও বেক্সিমকো গ্রুপের কোম্পানিগুলো আগের দিনই বিনিয়োগকারীদের কাঁপন ধরিয়েছিল। সেদিন ৪৮ পয়েন্ট সূচক পতনে এই গ্রুপের ছয় কোম্পানির অবদান ছিল ৩৮ পয়েন্ট।
পরদিন কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দরপতন হয়নি। বেড়েছে সামান্য।
আগের দিন দরপতনের শীর্ষে থাকা ওরিয়ন ফার্মার দর ২ টাকা ২০ পয়সা বা ১.৬৩ শতাংশ, ওরিয়ন ইনফিউশনের দর ৪ টাকা ৬০ পয়সা বা ০.৮১ শতাংশ, বিকন ফার্মার দর ২ টাকা ৪০ পয়সা বা ০.৭৬ শতাংশ বেড়েছে। তবে কোহিনূর কেমিক্যালসের দর কমেছে ৮ টাকা ৭০ পয়সা বা ১.৪৫ শতাংশ।
আগের দিন ৫ শতাংশের বেশি দর হারানো বেক্সিমকো ফার্মার দর ১ টাকা বা ০.৫৮ শতাংশ এবং বেক্সিমকো লিমিটেডের দর ১ টাকা ২০ পয়সা বা ০.৯১ শতাংশ বেড়েছে।
দিনভর উঠানামার পর বেলা শেষে সূচক কমেছে ৪ পয়েন্ট। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কোম্পানির দর ছিল আগের দিনের দামে, যেগুলোর প্রায় সবই আছে বেঁধে দেয়া সর্বনিম্ন দর বা ফ্লোর প্রাইসে। এই সংখ্যাটি ১৭৩। এদিন দরপতন হয়েছে ১৩৭টি কোম্পানির আর বেড়েছে ৬১টির।
সোমবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শেয়ার লেনদেন হয়েছে ফ্লোর প্রাইসে
গত ৩১ জুলাই থেকে সূচক ও লেনদেন বাড়তে থাকার মধ্যে প্রতিদিনই অনেক কোম্পানি দিনের দর বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমায় দেখা গেলেও সেটি এখন নেমে এসেছে একটিতে।
এদিন শুধু বিডিকমের দর বেড়েছে এক দিনে যতটা বাড়া যায় ততটাই। আর জেএমআই হসপিটালের দর সেই সীমা ছুঁয়ে কয়েক পয়সা কমে লেনদেন শেষ করেছে। আর চারটি কোম্পানির দর ৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
একইভাবে দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত কমেনি কোনো কোম্পানির দর। উৎপাদন শুরুর ঘোষণা দেয়ার আগে ৫ কর্মদিবসে ৪৬ শতাংশ দর বেড়ে যাওয়া আজিজ পাইপের দর কমেছে ৮.৫৫ শতাংশ। ছয় বছর পর পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরুর ঘোষণা দেয়ার আগে লাফাতে থাকা জুট স্পিনার্সের দর কমেছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭.১৬ শতাংশ।
আরও তিনটি কোম্পানির দর ৬ শতাংশের বেশি, আরও ৭টি কোম্পানির দর ৫ শতাংশের বেশি, আরও ৯টি কোম্পানির দর ৪ শতাংশের বেশি, আরও ৯টি কোম্পানির ৩ শতাংশের বেশি, ২২টি কোম্পানির দর ২ শতাংশের বেশি কমেছে।
ট্রেজার সিকিউরিটিজের শীর্ষ কর্মকর্তা মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দিনের শুরুর দিকে ট্রেন্ডি আইটেমগুলো একটু স্লো ছিল। যার প্রভাব সূচকে পড়েছে। তবে দুপুরের পর থেকে কিছুটা রিকোভার করতে দেখা যায়।’
তিনি যোগ করেন, ‘গতকালের বাজারের যে আচরণ ছিল, ট্রেন্ডি আইটেমগুলোর মন্থর গতির কারণে একটু প্যানিকের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই সাইড লাইনে চলে গেছেন। পর্যবেক্ষণ করছেন। হয়তবা কাল-পরশুর মধ্যে তারা আবার ফিরবেন। তাহলে আশা করা যায় যে, লেনদেন আবারও আগের অবস্থানে চলে আসবে।’
সূচক কমাল যারা
সবচেয়ে বেশি ১ দশমিক ১ পয়েন্ট সূচক কমেছে আইসিবির দরপতনে। কোম্পানিটির দর কমেছে ২ দশমিক ০৬ শতাংশ।
আর কোনো কোম্পানির দরপতনে এক পয়েন্ট সূচক কমেনি।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৮৭ পয়েন্ট কমেছে লাফার্জ হোলসিমের কারণে। শেয়ার প্রতি দাম কমেছে ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
সি পার্লের দর ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে শূন্য দশমিক ৭১ পয়েন্ট।
এ ছাড়া ইউনিক হোটেল, আইপিডিসি, ইউনিলিভার কেয়ার, ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ইনডেক্স অ্যাগ্রো, পেনিনসুলা ও অ্যানার্জিপ্যাক পাওয়ারের দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ৪ দশমিক ৮২ পয়েন্ট।
বিপরীতে কোনো কোম্পানিই এককভাবে এক পয়েন্ট সূচক বাড়াতে পারেনি।
সবচেয়ে বেশি শূন্য দশমিক ৯৯ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে জেএমআই হসপিটাল। এদিন শেয়ারটির দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের দর ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে শূন্য দশমিক ৮৬ পয়েন্ট।
বেক্সিমকো লিমিটেড সূচকে যোগ করেছে শূন্য দশমিক ৭২ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে শূন্য দশমিক ৯১ শতাংশ।
এর বাইরে শাহজিবাজার পাওয়ার, বার্জার পেইন্টস, বিকন ফার্মা, সাইফ পাওয়ার, ওরিয়ন ফার্মা, বেক্সিমকো ফার্মা ও বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ৫ দশমিক ৩৮ পয়েন্ট।
শীর্ষ ৫ খাত যেমন
শুধুমাত্র সেবা ও আবাসন খাতে ৭৫ শতাংশ কোম্পানির দরবৃদ্ধি দেখা গেছে। যদিও এ খাতের মোট কোম্পানির সংখ্যা তিন। যার মধ্যে দুটির দর বেড়েছে ও একটির কমেছে।
বাকি আর কোনো খাতেই দরবৃদ্ধি দেখা যায়নি।
লেনদেনের শীর্ষে রয়েছে বিবিধ খাত। ২৫৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা বা ২১.১৪ শতাংশ লেনদেনের বিপরীতে খাতটির ৫টি করে কোম্পানির দরবৃদ্ধি ও দরপতন হয়েছে। আর ৩টির লেনদেন হয়েছে আগের দরে।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ওষুধ ও রসায়ন খাতে লেনদেন হয়েছে ১৯৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা বা ১৬.১৭ শতাংশ। এদিন ৮টি কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে ১৪টির দরপতন ও ৯টির দর অপরিবর্তিত ছিল।
তৃতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে প্রকৌশল খাতে। মোট লেনদেনের ১১.৫৭ শতাংশ বা ১৪১ কোটি ৪০ লাখ টাকা লেনদেন হয়। খাতের ২৮টি কোম্পানির দরপতনের বিপরীতে বেড়েছে ৪টির দর ও অপরিবর্তিত ছিল ১০টির।
চতুর্থ অবস্থানে থাকা জ্বালানি খাতে দরপতন হয়েছে ১৭টি কোম্পানির, বেড়েছে ৪টির দাম। আর আগের দিনের দামে লেনদেন হয়েছে ২টি কোম্পানির শেয়ার।
মোট লেনদেনের ৮.৩৭ শতাংশ বা ১০২ কোটি ২৮ লাখ টাকা লেনদেন হয় খাতটিতে।
আর কোনো খাতের লেনদেন এক শ কোটি স্পর্শ করেনি।
পঞ্চম অবস্থানে থাকা বস্ত্র খাতে লেনদেন হয়েছে ৮০ কোটি ৪২ লাখ। ৪টি কোম্পানির দরবৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ২১টির। আর দাম অপরিবর্তিত থেকে লেনদেন হয়েছে ৩৩টি কোম্পানির শেয়ার।
এ ছাড়াও ভ্রমণ, প্রযুক্তি, সেবা ও আবাসন খাতে পঞ্চাশ কোটির ওপরে লেনদেন হয়েছে।
লেনদেনে সেরা ওরিয়ন-বেক্সিমকো
আগের দিন দরপতনের পরে আজ দরবৃদ্ধির সঙ্গে লেনদেনে শীর্ষ অবস্থান ধরে ওরিয়ন ফার্মা ও বেক্সিমকো লিমিটেড।
ওরিয়ন ফার্মার ৮৪ লাখ ৬৬ হাজার ৫৫৬টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে ১১৫ কোটি ১২ লাখ ১ হাজার টাকায়।
বেক্সিমকো লিমিটেডের লেনদেন হয়েছে ১১৪ কোটি ৬৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। হাতবদল হয়েছে ৮৬ লাখ ২১ হাজার ৪টি শেয়ার।
আর কোনো কোম্পানির লেনদেন এক শ কোটি টাকা ছুঁতে পারেনি।
তৃতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের। ৪২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৬৮ কোটি ৬৩ লাখ ৮৩ হাজার টাকায়।
জেএমআই হসপিটালের লেনদেন হয়েছে ৫৭ কোটি ৬ লাখ ৭২ হাজার টাকার।
এ ছাড়া শীর্ষ দশের মধ্যে থাকা ইস্টার্ন হাউজিং, ইউনিক হোটেল, শাহজিবাজার পাওয়ার, কপারটেক, শাইনপুকুর সিরামিকস ও সি পার্লের লেনদেন হয়েছে ২০ থেকে ৪০ কোটির মধ্যেই।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
দরবৃদ্ধির শীর্ষে অবস্থান করছে বিডিকম। ৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ দর বেড়ে শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৬৪ টাকা ৭০ পয়সায়। আগের দিনে ক্লোজিং প্রাইস ছিল ৫৯ টাকা।
৯ দশমিক ৬১ শতাংশ দর বেড়ে জেএমআই হসপিটালের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১৩২ টাকা ৩০ পয়সায়, আগের দিনের সর্বশেষ দর ছিল ১২০ টাকা ৭০ পয়সা।
৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ দর বেড়ে ৬১ টাকা ৩০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে তৃতীয় স্থানে থাকা ফাইন ফুডসের শেয়ার। আগের দিন দর ছিল ৫৬ টাকা ৯০ পয়সা।দরবৃদ্ধির তালিকায় শীর্ষ দশে ছিল ইয়াকিন পলিমার, শাহজিবাজার পাওয়ার, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, এডিএন টেলিকম, এশিয়া প্যাসিফিক জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, সাইফ পাওয়ার ও শাইনপুকুর সিরামিকস।
দর পতনের শীর্ষ ১০
পতনের তালিকার শীর্ষে ছিল আজিজ পাইপস। ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ দর কমে শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১২৮ টাকা ৩০ পয়সায়।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দর হারিয়েছে জুট স্পিনার্স। ৭ দশমিক ১৬ শতাংশ কমে শেয়ারটি সর্বশেষ ২২০ টাকা ৩০ পয়সায় হাতবদল হয়।
দর কমার শীর্ষ দশে থাকা অন্য কোম্পানিগুলো ছিল- নর্দার্ন জুট ম্যানুফ্যাকচারিং, পেনিনসুলা চিটাগং, সি পার্ল, পেপার প্রোসেসিং, মোজাফ্ফর স্পিনিং, অ্যাসোসিয়েটে অক্সিজেন, ইনডেক্স অ্যাগ্রো এবং এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিল।