সোনালি আঁশ আর রুপালি কাঠি- দুয়ে মিলে সম্ভাবনার ফসল পাট। একসময়ের সোনালি আঁশ একপর্যায়ে হয়ে দাঁড়ায় কৃষকের গলার ফাঁস। নানামুখী উদ্যোগে সেই পাট ঘিরে তৈরি হয়েছে নতুন সম্ভাবনা। ঘুরে দাঁড়াতে শুরুছে এই অর্থকরী ফসল। কিন্তু সেই ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সামনে এসেছে দুই প্রতিবন্ধকতা- কাঁচা পাটের ওপর উৎসে কর এবং প্রধান বাজার ভারতের অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপ।
সংকট সুরাহায় বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ)।
সংগঠনের চেয়ারম্যান মো. আবুল হোসেন জানান, পাট খাতের উন্নয়নে দুটি প্রধান বাধা স্পষ্ট। তা হচ্ছে কাঁচা পাটের ওপর ২ শতাংশ উৎসে কর এবং প্রধান রপ্তানি বাজার ভারতের অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি। এই বাধা দূর হলে পাট খাতের রপ্তানি কয়েক গুণ বাড়বে। ঘুরে দাঁড়াবে এই খাত।
বিজেএমএ মহাসচিব আব্দুল বারিক খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে উৎপাদিত কাঁচা পাট অত্যন্ত উন্নতমানের। সে সুবাদে বিশ্ববাজারে পাটের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু কাঁচা পাট রপ্তানিতে এ দুটি বাধা দূর করা জরুরি।
‘স্বাধীনতাপূর্ব ও পরবর্তী সময়ে পাটই ছিল একমাত্র বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। কিন্তু পাট খাতে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে কোনো সহায়তা দেয়া হয় না। বিদেশ থেকে তুলা আমদানিতে এই তহবিলের সুবিধা মেলে। তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানিকারকরা এ তহবিল থেকে বড় সহায়তা পান। অথচ স্বল্পসুদের এই তহবিল থেকে পাটশিল্প কোনো সহায়তা পায় না।’
বলা হচ্ছে, এ তিনটি সুবিধা বাস্তবায়ন করলে পাট রপ্তানি করে বর্তমানের চেয়ে পাঁচ গুণ আয় করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে কয়েক বছরের মধ্যে ৮ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার আয় আসবে পাট রপ্তানি থেকে।
ট্যারিফ কমিশনে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ‘কৃষক-শ্রমিকসহ পাটশিল্প খাতের সঙ্গে পাঁচ কোটি মানুষের জীবিকা জড়িত। পাট খাতে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে দুটি সমস্যা পাট খাতের উন্নয়ন ও সার্বিক কার্যক্রমে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্যা দুটি জরুরিভাবে সমাধান করা না হলে পাটশিল্প ক্রমান্বয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে। ফলে পাটপণ্য রপ্তানি ও রপ্তানি আয় ব্যাপকভাবে কমে যাবে।’
উৎসে কর
কাঁচা পাটের ওপর ২ শতাংশ উৎসে কর দেশের কৃষক ও ফড়িয়াদের ওপর পড়ে। ফলে কৃষকরা পাট উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হবেন এবং পাট উৎপাদন কমে যাবে। তাই কৃষক ও শ্রমিক বাঁচাতে কাঁচা পাটের ওপর উৎসে কর রহিত করা প্রয়োজন।
শতভাগ দেশীয় উৎপাদিত কাঁচা পাট দিয়ে বহুমুখী পণ্য উৎপাদন করা হয়। ২ শতাংশ উৎসে কর থাকলে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাবে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকা সম্ভব হবে না। পাটকলগুলোও একে একে বন্ধ হয়ে যাবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন কারণে পাটপণ্য টিকে থাকতে পারছে না। ২ শতাংশ উৎসে কর ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি
বাংলাদেশে পাটপণ্য রপ্তানির ওপর ২০১৭ সালে অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপ করায় ভারতে পাট রপ্তানি কমে গেছে। পাটের মিলগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চালু থাকা মিলগুলোও ঋণে জর্জরিত। ভারতের আরোপ করা এই অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি রোধকল্পে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) জরুরি ভিত্তিতে আপিল করে এ শিল্পকে রক্ষা করা জরুরি।
ইতোমধ্যে ভারতের মহাপরিচালক ট্রেড রিমিডিজের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল এ বিষয়ে তদন্ত করেছে। ভারত আগামী পাঁচ বছরের জন্য পুনরায় অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপ করতে চায়।
বাংলাদেশি পাটপণ্যের বড় বাজার ছিল ভারত। কিন্তু পাটপণ্য রপ্তানির ওপর অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে রাখায় দেশটিতে পাট সুতা রপ্তানি ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
চিঠিতে বিষয় দুটি জরুরি ভিত্তিতে সমাধানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়ার বিষয়ে ট্যারিফ কমিশনের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
পাট রপ্তানি
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে ওই অর্থবছরে ৬ লাখ ৮২ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়। তিন দশক আগেও দেশে ১২ লাখ হেক্টর জমিতে পাট উৎপাদিত হতো।
বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএসএ) সূত্রে জানা যায়, বছরে দেশে ৭৫ থেকে ৮০ লাখ বেল কাঁচা পাট উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে পাটপণ্য উৎপাদনের জন্য লাগে ৬০ লাখ বেল। আর ১০ থেকে ১২ লাখ বেল কাঁচা পাট রপ্তানি করে বাংলাদেশ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১১৬ কোটি ডলারেরও বেশি। ওই অর্থবছরে প্রায় ১৪ কোটি ডলার মূল্যের কাঁচা পাট রপ্তানি হয়েছে।