চলতি সপ্তাহের মধ্যে বুধবার সবচেয়ে বেশি সূচক পড়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই)। একই দিনে লেনদেন কমেছে হাজার কোটি টাকার বেশি।
বেশ কয়েক দিন ধরেই পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ করা যাচ্ছিল। প্রতিদিনই বেশিরভাগ শেয়ারের দরপতনে লেনদেন হয়েছে, কিন্তু সূচকের পতন দেখা গেছে মঙ্গলবার ও বুধবার। তার আগের দুই দিনে সূচকে যোগ হয় ৮৫ পয়েন্ট।
মঙ্গলবার ব্যাপক দরপতনেও সূচক কমে মাত্র ৪ পয়েন্ট, তবে সেই আচরণ থেকে আজ কিছুটা বের হয়ে এসেছে পুঁজিবাজার। বেশিরভাগ শেয়ারের দরপতনের সঙ্গে সূচক কমেছে ৪৫ পয়েন্ট।
যদিও এর চেয়ে বেশি পতনের শঙ্কা ছিল। ১১টা ৭ মিনিটেও আগের দিনের চেয়ে ২৯ পয়েন্ট বেড়ে লেনদেন হচ্ছিল, সূচকের অবস্থান ছিল ৬ হাজার ৬২৫ পয়েন্ট। মাঝে একটু কমলেও পরের এক ঘণ্টাতে সূচকের অবস্থান ছিল এর কাছাকাছিই।
এর পর থেকেই ধারাবাহিকভাবে দর হারাতে থাকে শেয়ারগুলো। দুপুর ১টা ৩২ মিনিটে দিনের সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে সূচক কমে যায় ৬৫ পয়েন্ট, তবে শেষ মুহূর্তের সমন্বয়ে ৪৫ পয়েন্ট কমে লেনদেন শেষ হয়েছে। সূচকের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫৫১ পয়েন্টে।
ডিএসইতে আগের দিনের চেয়ে বুধবার এক হাজার ২৪ কোটি ১১ লাখ ৬২ হাজার টাকা কম লেনদেন হয়; সূচক পড়ে ৪৫ পয়েন্ট। ছবি: সংগৃহীত
লেনদেন হওয়া সিকিউরিটিজের মধ্যে যতগুলোর দর বেড়েছে, তার দ্বিগুণের বেশি দরপতন হয়েছে। ৫৮টি শেয়ারের দরবৃদ্ধির বিপরীতে কমেছে ১৫৯টির। আগের দরেই লেনদেন হয়েছে ১৫৪টি শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিট।
কয়েক দিন থেকে আরেকটি প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। মোট লেনদেনের বড় অংশই থাকছে কয়েকটি কোম্পানির দখলে। বুধবারও তার ব্যতিক্রম দেখা যায়নি।
সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় ওরিয়ন ফার্মার। কোম্পানির ১ কোটি ৭৪ লাখ ১০২টি শেয়ার লেনদেন হয় ২৫৭ কোটি ২৫ লাখ ৯৩ হাজার টাকায়।
গ্রুপের আরেক কোম্পানি ওরিয়ন ইনফিউশনের লেনদেন হয় ৪০ কোটি ৩১ লাখ ৯০ হাজার টাকার। কোম্পানিটির ৬ লাখ ৬৪ হাজার ৮৭৭টি শেয়ার লেনদেন হওয়ার দিনে দর বেড়েছে ২০ টাকা ৪০ পয়সা।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে বেক্সিমকো লিমিটেডের। যদিও এদিন কোম্পানির দর কমেছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। ২২৯ কোটি ৬৯ লাখ ২৮ হাজার টাকায় হাতবদল হয় এক কোটি ৬৬ লাখ ৭১ হাজার ৫২৩টি শেয়ার।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের শেয়ার লেনদেন হয় ১০২ কোটি ২২ লাখ ৯৭ হাজার টাকার। হাতবদল হয় ৬৩ লাখ ৪১ হাজার ৪৪৫টি শেয়ার।
এসব কোম্পানির লেনদেন কমার সঙ্গে ডিএসইর মোট লেনদেন কমেছে।
মঙ্গলবার লেনদেন হয় ২ হাজার ৮৩২ কোটি ৩০ লাখ ৭৪ হাজার টাকা, যা চলতি বছরের তো বটেই, গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বরের পর সর্বোচ্চ। আর ২০১০ সালের মহাধসের পর এটি ছিল সপ্তম সর্বোচ্চ লেনদেন। অর্থাৎ এর চেয়ে আর মাত্র ছয়বার এত বেশি লেনদেন হয়েছে ডিএসইতে।
বুধবার হাতবদল হয়েছে এক হাজার ৮০৮ কোটি ১৯ লাখ ১২ হাজার টাকা। এ সংখ্যাটা আগের দিনের চেয়ে এক হাজার ২৪ কোটি ১১ লাখ ৬২ হাজার টাকা কম।
২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর দর সংশোধনে যায় পুঁজিবাজার। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে মতভেদ শেষে অর্থবছরের সমন্বয় হয়। সবশেষ ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ধস নামে পুঁজিবাজারে।
এর মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো ফ্লোর প্রাইস আরোপ এবং ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিট শেয়ারের ক্রয়মূল্য নির্ধারণের পর ৩১ জুলাই থেকে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে; ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে লেনদেন।
এই উত্থান শুরুর আগের কর্মদিবস ২৮ জুলাই সূচক নেমে যায় ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে। তা নিম্নমুখীই ছিল। এ নিয়ে বিনিয়োগকারীরা ছিলেন আতঙ্কে।
পরের কর্মদিবস থেকে ৬০০ পয়েন্টের বেশি হারিয়ে ফেলা সূচক ফিরে পেলেও বিনিয়োগকারীদের মনের খেদ মেটেনি। কারণ এই উত্থানের প্রভাব পুঁজিবাজারে সমভাবে পড়েনি। অল্প কিছু কোম্পানির শেয়ারের মাত্রাতিরিক্ত দরবৃদ্ধির মধ্যেও ফ্লোর প্রাইসে গড়াগড়ি খাচ্ছে শতাধিক কোম্পানি। এর মধ্যে কিছু দুর্বল কোম্পানি থাকলেও শক্তিশালী মৌলভিত্তির কোম্পানিও আছে।
লেনদেনে বিষয়ে ট্রেজার সিকিউরিটিজের শীর্ষ কর্মকর্তা মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘আজকের লেনদেন কম বলব না, বরং গতকাল ক্রেজি ট্রানজেকশন হয়েছিল বলা যায়।’
তিনি বলেন, ‘গতকালের এত বড় ট্রানজেকশনের পরে আজকে যে পজ নিয়েছে বা পুল ব্যাক করেছে, তা বাজারের জন্য ভালো বলে আমি মনে করি। মার্কেট মেকাররা খুব দক্ষতার সঙ্গে বাজার পরিচালনা করছে।’
মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘গতকালের যে লেনদেন, এরপরে আজকের যে সেল প্রেসার ছিল, তা রিমার্কেবল নয়। বেশিরভাগ সিকিউরিটজের দরপতনের সঙ্গে সূচক কমেছে।’
সূচক কমাল যারা
সবচেয়ে বেশি ১০ দশমিক ১১ পয়েন্ট সূচক কমেছে বেক্সিমকোর দরপতনে। কোম্পানিটির দর কমেছে ৩ দশমিক ১৪ শতাংশ।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ২৭ পয়েন্ট কমেছে বিকন ফার্মার কারণে। শেয়ার প্রতি দাম কমেছে ৪ দশমিক ২৪ শতাংশ।
লাফার্জ হোলসিমের দর ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ কমার কারণে সূচক কমেছে ৪ দশমিক ২৬ পয়েন্ট।
এ ছাড়া বেক্সিমকো ফার্মা, পাওয়ার গ্রিড, কোহিনূর কেমিক্যাল, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল, আরএকে সিরামিকস ও প্রাইম ব্যাংকের দরপতনে সূচক কমেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ৪০ দশমিক ৫৯ পয়েন্ট।
সূচক বাড়াল যারা
সবচেয়ে বেশি ৭ দশমিক ৯১ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে ইউনাইটেড পাওয়ার। এদিন শেয়ারটির দর বেড়েছে ২ দশমিক ২২ শতাংশ।
বসুন্ধরা পেপারের দর ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে ৩ দশমিক ৪৬ পয়েন্ট।
সি পার্ল সূচকে যোগ করেছে ৩ দশমিক ২৬ পয়েন্ট। কোম্পানির দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৯১ শতাংশ।
এর বাইরে ডোরিন পাওয়ার, বার্জার পেইন্টস, মীর আকতার, শাহজিবাজার পাওয়ার, জেএমআই হসপিটাল, ইনডেক্স অ্যাগ্রো ও পূবালী ব্যাংক সূচকে পয়েন্ট যোগ করেছে।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ২৬ দশমিক ০৫ পয়েন্ট।
কোন খাত কেমন
দরপতনের পাল্লা ভারী হওয়ায় কোনো খাতেই দরবৃদ্ধি দেখা যায়নি।
তবে আটটি বা ২৫ শতাংশের বেশি কোম্পানির দর বেড়েছে লেনদেনের শীর্ষে থাকা ওষুধ ও রসায়ন খাতে।
আগের দিনের চেয়ে ৩০০ কোটির মতো লেনদেন কমে হাতবদল হয়েছে ৪৫৬ কোটি ২০ লাখ টাকা, যা মোট লেনদেনের ২৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
বিপরীতে ১৬টি কোম্পানির দরপতন হয়েছে। আগের দরেই লেনদেন হয়েছে আরও ৭টি কোম্পানির শেয়ার।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বিবিধ খাতের লেনদেন হয়েছে ৪১৯ কোটি ৭৪ লাখ, অথচ গতকাল এটি ছিল ৫৯২ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
আগের দিনের চেয়ে লেনদেন কমলেও এই দুই খাতের লেনদেন মোট লেনদেনের ৫০ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
গতকালের মতোই আর কোনো খাতের লেনদেন ১০ শতাংশ অতিক্রম করতে পারেনি। তবে এক শ কোটির বেশি লেনদেন হয়েছে আরও দুটি খাতে।
তবে দরপতনের পাল্লাই ভারী ছিল খাতটিতে। ৭টি কোম্পানির দরপতনের বিপরীতে বেড়েছে ৪টির ও ২টির লেনদেন হয়েছে অপরিবর্তিত দরে।
প্রকৌশল খাত টপকে তৃতীয় অবস্থানে চলে এসেছে জ্বালানি খাত। ১২৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা লেনদেনের দিনে আটটি কোম্পানির দরবৃদ্ধি হয়েছে। বিপরীতে ১০টির দরপতন ও পাঁচটি কোম্পানির দর অপরিবর্তিত ছিল।
পরের স্থানে থাকা প্রকৌশল খাতে ৬টি কোম্পানির দরবৃদ্ধি হয়েছে, কমেছে ২৬টির। আগের দরে লেনদেন হয়েছে ১০টির।
দিনভর হাতবদল হয়েছে ১১৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
বস্ত্র খাতের লেনদেন অর্ধেকে নেমে এসেছে। গতকাল ১৪৭ কোটি ১০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছিল, সেটা আজকে দাঁড়িয়েছে ৭৫ কোটি ৬০ লাখ টাকায়, যা মোট লেনদেনের ৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
খাতের ৩টি কোম্পানির দর বেড়েছে, কমেছে ২১টির ও অপরিবর্তিত ছিল ৩৫টির।
আইটি খাতে লেনদেন হয়েছে ৭৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা বা ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ।
এ ছাড়া দুটি খাতে ৩ শতাংশের বেশি, পাঁচটি খাতে ২ শতাংশের বেশি, তিনটি খাতে ১ শতাংশের বেশি লেনদেন হয়েছে। এক শতাংশের নিচে লেনদেন হয়েছে পাঁচ খাতে।
এ ছাড়া আইটি, ভ্রমণ ও অবকাশ, কাগজ ও মুদ্রণ, জীবন বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বিমা, ট্যানারি খাতে অল্প কিছু কোম্পানির দরবৃদ্ধি হয়েছে। তবে সব খাতেই দরপতনই বেশি ছিল।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
দরবৃদ্ধির শীর্ষে অবস্থান করছে ইনডেক্স অ্যাগ্রো। ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ দর বেড়ে শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১২৫ টাকা ৬০ পয়সায়। আগের দিনে ক্লোজিং প্রাইস ছিল ১১৪ টাকা ২০ পয়সা।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দর বেড়েছে মীর আকতার হোসেন লিমিটেডের। ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বেড়েছে শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৬০ টাকা ৯০ পয়সায়, আগের দিনের সর্বশেষ দর ছিল ৫৫ টাকা ৪০ পয়সা।
তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছে সি পার্ল। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে কোম্পানি শেয়ার প্রতি ১ টাকা ৭ পয়সা লোকসানে রয়েছে।
বুধবার ৯ দশমিক ৯১ শতাংশ দর বেড়ে প্রতিটি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১১৪ টাকা ২০ পয়সায়। আগের দিন দর ছিল ১০৩ টাকা ৯০ পয়সা।
এ ছাড়া দরবৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে বসুন্ধরা পেপার, অ্যাডভেন্ট ফার্মা, বিডিকম, ডোরিন পাওয়ার, আরএসআরএম স্টিল, এডিএন টেলিকম ও ইন্দো-বাংলা ফার্মা।
দর পতনের শীর্ষ ১০
পতনের তালিকার শীর্ষে রয়েছে জুট স্পিনার্স। পুঞ্জিভূত লোকসান ও অপারেশনে না থাকার পরেও লাফিয়ে লাফিয়ে দর বাড়তে দেখা গেছে কোম্পানিটির শেয়ারের।
বুধবার ৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ কমে প্রতিটি শেয়ার সর্বশেষ ২৪৩ টাকা ১০ পয়সায় লেনদেন হয়।
পতনের তালিকায় পরের স্থানে রয়েছে আরেক লোকসানি কোম্পানি বিডি ওয়েলডিং। ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ দর কমে লেনদেন হয়েছে ২৭ টাকা ৯০ পয়সায়।
তৃতীয় সর্বোচ্চ দর হারিয়েছে ন্যাশনাল টি। বিশাল লোকসান থাকার পরে কোম্পানির শেয়ার বেড়েছিল, বুধবার ৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ কমে শেয়ারটি সর্বশেষ ৬৪৩ টাকা ৩০ পয়সায় হাতবদল হয়।
দর কমার শীর্ষ দশে থাকা অন্য কোম্পানিগুলো ছিল- ইস্টার্ন ক্যাবলস, নর্দার্ন জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি, অ্যাটলাস বাংলাদেশ, সিনোবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজ, সোনালী আঁশ, আজিজ পাইপস ও কোহিনূর কেমিক্যালস।