চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে (২০২৩ সালের জুন শেষে) বাংলাদেশের অর্থনীতি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ বাড়তে পারে বলে আভাস দিয়েছে ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থাটি।
অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ হবে বলে তথ্য দিয়েছে এডিবি। সংস্থাটির ধারণা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়বে।
বৈশ্বিক অর্থনীতির শ্লথগতি এবং স্থানীয় পর্যায়ে মানুষের ভোগ-চাহিদা কমে যাওয়ায় চলতি বছর গত বছরের চেয়ে প্রবৃদ্ধি কম হবে বলে জানিয়েছে এডিবি।
বুধবার এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক সেপ্টেম্বর সংস্করণ প্রকাশ করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। সেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে এ পূর্বাভাস দেয়া হয়। এ উপলক্ষে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এডিবির ঢাকা কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
এতে এডিবির সিনিয়র কান্ট্রি স্পেশালিস্ট সুন চ্যাঙ হং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুকের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। বক্তব্য দেন এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর এডিমন গিন্টিং।
সরকার চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে। আর গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪ শতাংশে আটকে রাখতে চেয়েছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় বাংলাদেশে। গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ।
বর্তমান বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটে উচ্চমূল্যস্ফীতি নতুন চ্যালেঞ্জ বলে মনে করে এডিবি।
সংবাদ সম্মেলনে এডিমন গিন্টিং বলেন, ‘দুই বছরের কোভিড-১৯-এর ধাক্কার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে সংকটের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেও বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলে আমি সেটাকেই খুবই সন্তোষজনক বলে মনে করি। বাংলাদেশ অতীতেও নানা ধরনের সংকট সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। কোভিড-১৯ মোকাবিলা করেছে অত্যন্ত ভালোভাবে। যুদ্ধের মধ্যেও অর্থনীতিকে সঠিক পথে রেখেছে। রপ্তানির পাশাপাশি রেমিট্যান্স বাড়ছে। সবচেয়ে উদ্বেগ ছিল যে আমদানি, সেটা কমতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।’
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘায়িত অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাকে তুলনামূলক ভালোভাবে মোকাবিলা করেছে এবং এই অসম পরিস্থিতির ব্যবস্থাপনায় উপযুক্ত নীতিমালা বাস্তবায়ন করেছে।'
এডিমন গিন্টিং বলেন, 'তবে এ ধরনের সময় মধ্যম পর্যায়ে দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য, সংস্কারের জন্য উপযুক্ত। এ ধরনের সংস্কার কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যবহারের উপযোগিতা বাড়ানো, অর্থবাজারের উন্নয়ন এবং বেসরকারি খাতে ফলপ্রসূ চাকরি তৈরির জন্য প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের প্রচারণা।'
'আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারের অনিশ্চয়তা সংস্কার কর্মসূচিকে গতিশীল করার ভালো নিয়ামক হতে পারে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষ্য অর্জন ও স্থানীয় টেকসই জ্বালানির সরবরাহ সম্প্রসারণের মাধ্যমে জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমতে পারে।'
গিন্টিং বলেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় এবং জ্বালানি সংকটের কারণে এ বছর কাঙ্ক্ষিত হারে বিনিয়োগ হবে না। ধীরগতি দেখা দেবে সরকারি বিনিয়োগেও। এ অবস্থায় রাজস্ব আদায় বাড়াতে সরকারকে জোর দিতে হবে।’
‘রপ্তানি আয়ে বৈচিত্র্য আসছে। কৃষি ও ওষুধ খাতে বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি হচ্ছে। প্রবাসী আয়ও বাড়ছে। আমি মনে করি, রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্যই অর্থনীতিকে টেকসই করে। যেহেতু প্রবৃদ্ধি দেশের ভেতর থেকেই হতে হবে, তাই বেসরকারি খাতের বিকাশ প্রয়োজন।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা ও জ্বালানি ঘাটতির কারণে বেসরকারি বিনিয়োগের বৃদ্ধি কম হবে। সে কারণেই চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরের ৭ দশমিক ২৫ শতাংশের কম, ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হবে।
প্রতিবেদনে মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বলা হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের আমদানি খরচ বেড়েছে। অনেক দেশে খাদ্যসংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে অনেক দেশে খাদ্য উৎপাদন কম হয়েছে। যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে; ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে।’
‘সব মিলিয়ে ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় এবং বিভিন্ন পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় গত অর্থবছরের ৬ দশমিক ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেড়ে ৬ দশমিক ৭ শতাংশে উঠতে পারে।’
বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চয়তাকে চিহ্নিত করেছে এডিবি। এ কারণে দেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা দীর্ঘায়িত হতে পারে বলেও মনে করে এডিবি।
প্রতিবেদনে গত অর্থবছরে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ক্যারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স) প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘আমদানি কমে এবং রেমিট্যান্স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চলতি হিসাবের ঘাটতি ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির ৪ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কমে জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।’
‘তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দার কারণে রপ্তানিতে ঝুঁকি আছে।’
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দেশটির অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চয়তা।’
৪৯ বছরের অংশীদারত্বে বাংলাদেশকে এডিবি প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে।